তখন বর্ধমানে অনেক শীত পড়তো। ডিসেম্বরে ছাদে সবাই রোদ পোহাতো...এরকমই একটা দিনে অ্যাপোলো হাসপাতালে ও জন্মেছিলো। এতটুকু বিড়াল বাচ্চার সাইজের... মাথার পিছনে একটা আলু... কিভাবে ঐরকম আলু হয়েছিলো কেউ জানেনা। হয়তো পেটে থাকতে কোনোভাবে আঘাত পেয়ে গেছিলো। পজিশন খারাপ থাকায় সময়ের আগেই সিজারিয়ান করতে হয়েছিলো।
হাসপাতালের ছাদে শীতের নরম রোদে বাচ্চাদের দোলনায় সারি সারি বাচ্চা... দাদি এসেছেন নতুন জন্মানো নাতনীকে দেখতে।
হাসপাতালের আয়ারা মজা করে দাদিকে বললেন কোনটা নাতনী বলুন দেখি। দাদি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অন্তত দশ পনেরোটা বাচ্চা শুয়ে। আয়াদের বললেন ঐ কোণের সবথেকে ধবধবে সাদা বাচ্চাটা আমার নাতনী।
দুধে আলতা রং... টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট.. গভীর পাপড়িওলা চোখের মেয়েটা বরাবরই রোগা... শুশুক প্রকৃতির। কেউ জোরে কথা বললেও ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেলবে মনে হয়।
আমি তখন দেড় বছরের বাচ্চা... তারপরেও কোনোভাবে ঝাপসা দৃশ্যটা মাথায় আটকে গেছে। আম্মু হাসপাতাল থেকে রিক্সায় বাড়ি ফিরছে.. কোলে হলুদ জামা পরা পুতুলটা।
এই পুতুলটাকে আমি ভাই বলতাম কারণ আমার ভাইয়ের শখ ছিলো অনেক...ওর দোলনায় উঠে বসে থাকতাম। আম্মু সর্বদা নজরে রাখতো ভাই ভাই করার আতিশয্যে বাচ্চার ক্ষতি না হয়ে যায়।
ছোটোবেলায় যারাই বাড়িতে আসতো আম্মুকে বলতো তোমার এই ছোটো মেয়েটা এত্ত সুন্দর... পরীর মতো সুন্দর। আমার ভীষণ রাগ হতো... আমারই বোন আর আমার থেকেও সুন্দর কি করে হয়?
বড়ো হওয়ার সুবাদে সব জিনিষে আমার অধিকার ছিলো প্রথমে, তারপরে নিউয়ের... সে স্কুলের বই থেকে আরম্ভ করে নতুন সোয়েটার। তারপর আমার দরকার মিটে গেলে সেটা নিউ পেতো। ছোটোবেলায় আমি বড্ড হিংসুটে ছিলাম। আমার সবথেকে ভালো জিনিষটাই চাই... আর ঐ সুন্দর পুতুলের মতো মেয়েটা প্রায় সব জিনিষই পেতো আমার ব্যবহার করা।
প্রথমবার যখন আবৃত্তি কমপিটিশনে ও প্রথম হয়ে গেলো, আর আমি দ্বিতীয় ...আমি হাত পা ছড়িয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিলাম। আম্মুকে বলেছিলাম তুমি ওকে বেশী ভালোবাসো তাই ওকে বেশী ভালো করে শিখিয়েছো।
নিউ প্রচন্ড পরিশ্রমী। সবকাজেই অনেক পরিশ্রম করে... যখন প্রথম গান শিখতে শুরু করে হাতটা হারমোনিয়ামের বেলো অবধি পৌঁছাতো না। আম্মু ওকে দুটো বালিশের উপরে বসিয়ে দিতো... ঐ টুকু মেয়ে ভোরবেলায় উঠে রেওয়াজ করতো প্রতিদিন। আর তখন হাত পা ছড়িয়ে আমি ঘুমাতাম।
আঁকা থেকে আরম্ভ করে পড়াশোনা সবকিছুই মেয়েটা যত্ন নিয়ে অভ্যাস করতো...এদিকে তখন আমি পড়াশোনা না করার জন্য ঠ্যাঙানি খাচ্ছি। আম্মু বরাবর বলতো ছোটো বোনকে দেখেও তো শিখতে পারিস... নিউকে কখনো কিছু বলতে হয়নি। আমার ঠ্যাঙানি দেখেই ও শিখে যেতো ওকে কি করতে হবে। কখনো মার খায়নি.. সবার চোখের মণি, বাধ্য, শান্ত, সবার হুকুমে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে , তবু মুখে টুঁ শব্দটা নেই।
সেখানে আমি হলাম অবাধ্য, হাড় বজ্জাত , মুখে মুখে তর্ক করা বেতমিজ একটা মেয়ে...
পুতুলটা যত বড়ো হতে লাগলো আরো সুন্দর হতে শুধু করলো.. মধুবালার মতো ঠোঁটের নীচে তিল, হাসির মাঝে গজদন্ত... ঈশ্বর যেন বড়ো যত্ন করে বানিয়েছে!
নিউয়ের উপর অধিকার চাপানো আমার স্বভাব ছিলো। ওটা আমার বোন... অতএব আমার মতো করেই চলতে হবে এইরকম একটা ব্যাপার। ভীতু, শান্ত মেয়েটাকে কেউ কিছু বললে আমার ঝগড়া করতে মন হতো। মনে হতো মেরেই দেবো আজকে... কি সাহস, আমার বোনের দিকে নজর দেয়!!!
তারপরেও কেমন করে যেন ভীতু মেয়েটা বড়ো হয়ে গেলো... সেই মেয়েটা যে বুড়ি ফুলওয়ালীর কাছ থেকে সবফুল কিনে বাড়ি চলে আসে... সেই মেয়েটা যে রাস্তার খালি পায়ের পথশিশুদের দেখে জুতো কিনে বাড়ি দিয়ে আসে... সেই মেয়েটা যে কেরালা বন্যাত্রাণই হোক কিংবা কৃষক মিছিল , তার জন্য অফিসে লাখ লাখ চাঁদা তোলে...
সেই মেয়েটা যে কিনা দারুন সুন্দর আঁকে... যার জুতোর সংখ্যা জয়ললিতার আলমারীকেও লজ্জা দেবে... যে মেয়েটা একশো টাকা দিলে ষাটটাকা জমিয়ে ফেলে, যে কিনা গরীব মানুষদের শীতের সময় একা হাতে কম্বল দান করে... যে মেয়েটা কখনো কাউকে খালি হাতে ফেরায়নি... যার পায়ের তলায় সরষে আছে
আজকে সেই মেয়েটার জন্মদিন... ঐ পুতুলের মতো মেয়েটার জন্মদিন... যে ছোটো হয়েও আমাকে দিদির মতো সামলেছে... যে এখনো আমার দরকার অদরকার খুঁটি নাটি খেয়াল রাখে... যে মেয়েটা প্রায় একা হাতে আমার বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছিলো.. আজ তার জন্মদিন।
হাসপাতালের ছাদে শীতের নরম রোদে বাচ্চাদের দোলনায় সারি সারি বাচ্চা... দাদি এসেছেন নতুন জন্মানো নাতনীকে দেখতে।
হাসপাতালের আয়ারা মজা করে দাদিকে বললেন কোনটা নাতনী বলুন দেখি। দাদি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অন্তত দশ পনেরোটা বাচ্চা শুয়ে। আয়াদের বললেন ঐ কোণের সবথেকে ধবধবে সাদা বাচ্চাটা আমার নাতনী।
দুধে আলতা রং... টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট.. গভীর পাপড়িওলা চোখের মেয়েটা বরাবরই রোগা... শুশুক প্রকৃতির। কেউ জোরে কথা বললেও ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেলবে মনে হয়।
আমি তখন দেড় বছরের বাচ্চা... তারপরেও কোনোভাবে ঝাপসা দৃশ্যটা মাথায় আটকে গেছে। আম্মু হাসপাতাল থেকে রিক্সায় বাড়ি ফিরছে.. কোলে হলুদ জামা পরা পুতুলটা।
এই পুতুলটাকে আমি ভাই বলতাম কারণ আমার ভাইয়ের শখ ছিলো অনেক...ওর দোলনায় উঠে বসে থাকতাম। আম্মু সর্বদা নজরে রাখতো ভাই ভাই করার আতিশয্যে বাচ্চার ক্ষতি না হয়ে যায়।
ছোটোবেলায় যারাই বাড়িতে আসতো আম্মুকে বলতো তোমার এই ছোটো মেয়েটা এত্ত সুন্দর... পরীর মতো সুন্দর। আমার ভীষণ রাগ হতো... আমারই বোন আর আমার থেকেও সুন্দর কি করে হয়?
বড়ো হওয়ার সুবাদে সব জিনিষে আমার অধিকার ছিলো প্রথমে, তারপরে নিউয়ের... সে স্কুলের বই থেকে আরম্ভ করে নতুন সোয়েটার। তারপর আমার দরকার মিটে গেলে সেটা নিউ পেতো। ছোটোবেলায় আমি বড্ড হিংসুটে ছিলাম। আমার সবথেকে ভালো জিনিষটাই চাই... আর ঐ সুন্দর পুতুলের মতো মেয়েটা প্রায় সব জিনিষই পেতো আমার ব্যবহার করা।
প্রথমবার যখন আবৃত্তি কমপিটিশনে ও প্রথম হয়ে গেলো, আর আমি দ্বিতীয় ...আমি হাত পা ছড়িয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিলাম। আম্মুকে বলেছিলাম তুমি ওকে বেশী ভালোবাসো তাই ওকে বেশী ভালো করে শিখিয়েছো।
নিউ প্রচন্ড পরিশ্রমী। সবকাজেই অনেক পরিশ্রম করে... যখন প্রথম গান শিখতে শুরু করে হাতটা হারমোনিয়ামের বেলো অবধি পৌঁছাতো না। আম্মু ওকে দুটো বালিশের উপরে বসিয়ে দিতো... ঐ টুকু মেয়ে ভোরবেলায় উঠে রেওয়াজ করতো প্রতিদিন। আর তখন হাত পা ছড়িয়ে আমি ঘুমাতাম।
আঁকা থেকে আরম্ভ করে পড়াশোনা সবকিছুই মেয়েটা যত্ন নিয়ে অভ্যাস করতো...এদিকে তখন আমি পড়াশোনা না করার জন্য ঠ্যাঙানি খাচ্ছি। আম্মু বরাবর বলতো ছোটো বোনকে দেখেও তো শিখতে পারিস... নিউকে কখনো কিছু বলতে হয়নি। আমার ঠ্যাঙানি দেখেই ও শিখে যেতো ওকে কি করতে হবে। কখনো মার খায়নি.. সবার চোখের মণি, বাধ্য, শান্ত, সবার হুকুমে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে , তবু মুখে টুঁ শব্দটা নেই।
সেখানে আমি হলাম অবাধ্য, হাড় বজ্জাত , মুখে মুখে তর্ক করা বেতমিজ একটা মেয়ে...
পুতুলটা যত বড়ো হতে লাগলো আরো সুন্দর হতে শুধু করলো.. মধুবালার মতো ঠোঁটের নীচে তিল, হাসির মাঝে গজদন্ত... ঈশ্বর যেন বড়ো যত্ন করে বানিয়েছে!
নিউয়ের উপর অধিকার চাপানো আমার স্বভাব ছিলো। ওটা আমার বোন... অতএব আমার মতো করেই চলতে হবে এইরকম একটা ব্যাপার। ভীতু, শান্ত মেয়েটাকে কেউ কিছু বললে আমার ঝগড়া করতে মন হতো। মনে হতো মেরেই দেবো আজকে... কি সাহস, আমার বোনের দিকে নজর দেয়!!!
তারপরেও কেমন করে যেন ভীতু মেয়েটা বড়ো হয়ে গেলো... সেই মেয়েটা যে বুড়ি ফুলওয়ালীর কাছ থেকে সবফুল কিনে বাড়ি চলে আসে... সেই মেয়েটা যে রাস্তার খালি পায়ের পথশিশুদের দেখে জুতো কিনে বাড়ি দিয়ে আসে... সেই মেয়েটা যে কেরালা বন্যাত্রাণই হোক কিংবা কৃষক মিছিল , তার জন্য অফিসে লাখ লাখ চাঁদা তোলে...
সেই মেয়েটা যে কিনা দারুন সুন্দর আঁকে... যার জুতোর সংখ্যা জয়ললিতার আলমারীকেও লজ্জা দেবে... যে মেয়েটা একশো টাকা দিলে ষাটটাকা জমিয়ে ফেলে, যে কিনা গরীব মানুষদের শীতের সময় একা হাতে কম্বল দান করে... যে মেয়েটা কখনো কাউকে খালি হাতে ফেরায়নি... যার পায়ের তলায় সরষে আছে
আজকে সেই মেয়েটার জন্মদিন... ঐ পুতুলের মতো মেয়েটার জন্মদিন... যে ছোটো হয়েও আমাকে দিদির মতো সামলেছে... যে এখনো আমার দরকার অদরকার খুঁটি নাটি খেয়াল রাখে... যে মেয়েটা প্রায় একা হাতে আমার বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছিলো.. আজ তার জন্মদিন।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা মোনালিসা (সুন্দর হাসির জন্য আব্বু আদর করে মোনালিসা নাম দিয়েছিলো)
তার আরো একটা নাম আছে... নিউ সান... নতুন সূর্য।
আমি তোকে এখনো হিংসা করি... একটা মানুষ এতো ভালো কি করে হয়?