Friday, 21 December 2018

মোনালিসার জন্মদিনে

তখন বর্ধমানে অনেক শীত পড়তো। ডিসেম্বরে ছাদে সবাই রোদ পোহাতো...এরকমই একটা দিনে অ্যাপোলো হাসপাতালে ও জন্মেছিলো। এতটুকু বিড়াল বাচ্চার সাইজের... মাথার পিছনে একটা আলু... কিভাবে ঐরকম আলু হয়েছিলো কেউ জানেনা। হয়তো পেটে থাকতে কোনোভাবে আঘাত পেয়ে গেছিলো। পজিশন খারাপ থাকায় সময়ের আগেই সিজারিয়ান করতে হয়েছিলো।
হাসপাতালের ছাদে শীতের নরম রোদে বাচ্চাদের দোলনায় সারি সারি বাচ্চা... দাদি এসেছেন নতুন জন্মানো নাতনীকে দেখতে।
হাসপাতালের আয়ারা মজা করে দাদিকে বললেন কোনটা নাতনী বলুন দেখি। দাদি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অন্তত দশ পনেরোটা বাচ্চা শুয়ে। আয়াদের বললেন ঐ কোণের সবথেকে ধবধবে সাদা বাচ্চাটা আমার নাতনী।
দুধে আলতা রং... টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট.. গভীর পাপড়িওলা চোখের মেয়েটা বরাবরই রোগা... শুশুক প্রকৃতির। কেউ জোরে কথা বললেও ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেলবে মনে হয়।
আমি তখন দেড় বছরের বাচ্চা... তারপরেও কোনোভাবে ঝাপসা দৃশ্যটা মাথায় আটকে গেছে। আম্মু হাসপাতাল থেকে রিক্সায় বাড়ি ফিরছে.. কোলে হলুদ জামা পরা পুতুলটা।
এই পুতুলটাকে আমি ভাই বলতাম কারণ আমার ভাইয়ের শখ ছিলো অনেক...ওর দোলনায় উঠে বসে থাকতাম। আম্মু সর্বদা নজরে রাখতো ভাই ভাই করার আতিশয্যে বাচ্চার ক্ষতি না হয়ে যায়।
ছোটোবেলায় যারাই বাড়িতে আসতো আম্মুকে বলতো তোমার এই ছোটো মেয়েটা এত্ত সুন্দর... পরীর মতো সুন্দর। আমার ভীষণ রাগ হতো... আমারই বোন আর আমার থেকেও সুন্দর কি করে হয়?
বড়ো হওয়ার সুবাদে সব জিনিষে আমার অধিকার ছিলো প্রথমে, তারপরে নিউয়ের... সে স্কুলের বই থেকে আরম্ভ করে নতুন সোয়েটার। তারপর আমার দরকার মিটে গেলে সেটা নিউ পেতো। ছোটোবেলায় আমি বড্ড হিংসুটে ছিলাম। আমার সবথেকে ভালো জিনিষটাই চাই... আর ঐ সুন্দর পুতুলের মতো মেয়েটা প্রায় সব জিনিষই পেতো আমার ব্যবহার করা।
প্রথমবার যখন আবৃত্তি কমপিটিশনে ও প্রথম হয়ে গেলো, আর আমি দ্বিতীয় ...আমি হাত পা ছড়িয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিলাম। আম্মুকে বলেছিলাম তুমি ওকে বেশী ভালোবাসো তাই ওকে বেশী ভালো করে শিখিয়েছো।
নিউ প্রচন্ড পরিশ্রমী। সবকাজেই অনেক পরিশ্রম করে... যখন প্রথম গান শিখতে শুরু করে হাতটা হারমোনিয়ামের বেলো অবধি পৌঁছাতো না। আম্মু ওকে দুটো বালিশের উপরে বসিয়ে দিতো... ঐ টুকু মেয়ে ভোরবেলায় উঠে রেওয়াজ করতো প্রতিদিন। আর তখন হাত পা ছড়িয়ে আমি ঘুমাতাম।
আঁকা থেকে আরম্ভ করে পড়াশোনা সবকিছুই মেয়েটা যত্ন নিয়ে অভ্যাস করতো...এদিকে তখন আমি পড়াশোনা না করার জন্য ঠ্যাঙানি খাচ্ছি। আম্মু বরাবর বলতো ছোটো বোনকে দেখেও তো শিখতে পারিস... নিউকে কখনো কিছু বলতে হয়নি। আমার ঠ্যাঙানি দেখেই ও শিখে যেতো ওকে কি করতে হবে। কখনো মার খায়নি.. সবার চোখের মণি, বাধ্য, শান্ত, সবার হুকুমে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে , তবু মুখে টুঁ শব্দটা নেই।
সেখানে আমি হলাম অবাধ্য, হাড় বজ্জাত , মুখে মুখে তর্ক করা বেতমিজ একটা মেয়ে...
পুতুলটা যত বড়ো হতে লাগলো আরো সুন্দর হতে শুধু করলো.. মধুবালার মতো ঠোঁটের নীচে তিল, হাসির মাঝে গজদন্ত... ঈশ্বর যেন বড়ো যত্ন করে বানিয়েছে!
নিউয়ের উপর অধিকার চাপানো আমার স্বভাব ছিলো। ওটা আমার বোন... অতএব আমার মতো করেই চলতে হবে এইরকম একটা ব্যাপার। ভীতু, শান্ত মেয়েটাকে কেউ কিছু বললে আমার ঝগড়া করতে মন হতো। মনে হতো মেরেই দেবো আজকে... কি সাহস, আমার বোনের দিকে নজর দেয়!!!
তারপরেও কেমন করে যেন ভীতু মেয়েটা বড়ো হয়ে গেলো... সেই মেয়েটা যে বুড়ি ফুলওয়ালীর কাছ থেকে সবফুল কিনে বাড়ি চলে আসে... সেই মেয়েটা যে রাস্তার খালি পায়ের পথশিশুদের দেখে জুতো কিনে বাড়ি দিয়ে আসে... সেই মেয়েটা যে কেরালা বন্যাত্রাণই হোক কিংবা কৃষক মিছিল , তার জন্য অফিসে লাখ লাখ চাঁদা তোলে...
সেই মেয়েটা যে কিনা দারুন সুন্দর আঁকে... যার জুতোর সংখ্যা জয়ললিতার আলমারীকেও লজ্জা দেবে... যে মেয়েটা একশো টাকা দিলে ষাটটাকা জমিয়ে ফেলে, যে কিনা গরীব মানুষদের শীতের সময় একা হাতে কম্বল দান করে... যে মেয়েটা কখনো কাউকে খালি হাতে ফেরায়নি... যার পায়ের তলায় সরষে আছে
আজকে সেই মেয়েটার জন্মদিন... ঐ পুতুলের মতো মেয়েটার জন্মদিন... যে ছোটো হয়েও আমাকে দিদির মতো সামলেছে... যে এখনো আমার দরকার অদরকার খুঁটি নাটি খেয়াল রাখে... যে মেয়েটা প্রায় একা হাতে আমার বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছিলো.. আজ তার জন্মদিন।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা মোনালিসা (সুন্দর হাসির জন্য আব্বু আদর করে মোনালিসা নাম দিয়েছিলো)
তার আরো একটা নাম আছে... নিউ সান... নতুন সূর্য।
আমি তোকে এখনো হিংসা করি... একটা মানুষ এতো ভালো কি করে হয়?

জলছবি

১) জুঁইয়ের বাড়ির সামনের দরজায় কে লিখে দিয়ে গেছে “আই লাভ ইউ জুঁই।”
এসব দেখে কাকু ভীষণ খেপে গেছে... ওপাড়ায় গিয়ে পলাশকে চমকে এসেছে... মনে হয় পলাশই এই কাজটি করেছে।
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যাচ্ছে কৈশোরের ভালোবাসা।
২) আব্বুর দাঁত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। টেবিলের উপরেই রাখা ছিলো। তারপরেই দেখছে আর নেই। বেশ ছোটো বেলায় পোকা হওয়ায় কটা দাঁত তুলে দিতে হয়েছিলো। 
আম্মু অনেক গোয়েন্দাগিরি করে বের করেছে আসল কালপ্রিটকে। আম্মুর ধারণা খামারে থাকা মেঠো ইঁদুরের কীর্তি এটা। ধানের সময়ে খামারে ইঁদুরের উৎপাত থাকে ভালোই।
আম্মু প্রফুল্লচিত্তে তেনার এই গোয়েন্দাগিরির কথা আমাদেরকে বলাতে আব্বু ভীষণ রেগে গেছে। ইঁদুরের এই ভয়ানক সাহস আব্বুর একদমই পছন্দ হয়নি।
নিউ আব্বুকে আবার বলেছে ‘আব্বু ছোটো বেলায় দুধদাঁত ইঁদুরকে দিয়ে বলেনি “ইঁদুর তোমার দাঁত আমাকে দাও.. আমার দাঁত তুমি নাও।”
তাই এতদিন পরে ইঁদুর রেগে গিয়ে আব্বুর দাঁত নিয়ে চলে গেছে।’ এইটা শুনে আব্বু আরো রেগে গেছে।
৩) মৃদুলভাই আজকে খুব রেগে। এত ঘটা করে প্রপোজ করার পরেও রিজেক্ট খেয়েছে। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণ রাগে কচমচ করে পাতা সুদ্ধ লাল গোলাপটা খেয়ে ফেললো।
আমি , নিউ , ছোটোমামা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। এইসময় খিল্লি করা উচিত কিনা সেটা নিয়ে ছোটোমামা ভাবছে।
৪) ছোটোমামার পকেট থেকে আম্মু লাইটার খুঁজে পেয়েছে। মামার খবর আছে আজকে... আমরা চার ভাইবোন ঘুরছি ফিরছি আর আম্মুর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছি।
৫) গোলামবাবুর ব্যাচে ঢুকতেই ব্যাচমেটরা সেলিম সেলিম করে চেঁচিয়ে উঠলো।
রাগে দুকান লাল হয়ে গেছে আমার। স্থিতু হয়ে স্যারের পাশে বসতেই আবার সেলিম সেলিম চীৎকার। রেগে গিয়ে সামনের রাখা জলভর্তি বোতলটা ছুঁড়ে মারলাম ওদের দিকে।
গোলামবাবু মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে.. আহা রাগ করে না পিউ, ঠান্ডা হ। চল ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র টা দেখা যাক আজকে।
৬) আজ সকাল আটটার সময়ে নিউ আর সারমিনকে আব্বু নীলপুরে সাইকেল করে ঘুরতে দেখেছে। আব্বুর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক আব্বু রেগে আছে কি নেই... খাবার টেবিলে আব্বু জিজ্ঞাসা করলো ফুলের দোকানের সামনে কি করছিলো নিউ।
কাঁচুমাঁচু মুখে নিউ উত্তর দিলো ভ্যালেন্টাইনসডে তে দিদিমণির জন্য ফুল কিনছিলো। আব্বুর দিকে তাকানোর আর সাহস হচ্ছেনা কারোরই...আব্বু বিরক্ত হয়ে বোধহয় ভাবছে এসব ভ্যালেনটাইনস ডেই বা কি... আর তাতে দিদিমণিকে ফুলই বা দিতে হবে কেন!
টুকরো টুকরো স্মৃতি... আহা... যখনি পিছন ঘুরে তাকাই একরাশ হাসি কান্না প্রেম রাগ মারামারি মিশ্রিত জলছবি দেখি... ভালোবাসার জীবন.. হ্যারি পটারের অ্যালবামের ছবির মতো মুহূর্তরা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে মনের মণিকোঠায়।
স্মৃতি সততই সুখের...

Friday, 14 December 2018

জার্মানী ডাইরী-১

পরবাস পর্ব:
অদ্ভুত একটা দেশে এসে পড়েছি! এদেশের আকাশ সবসময় মেঘাচ্ছন্ন.. সূর্য ওঠেই না বললে চলে! হয় বৃষ্টি নয়তো বরফ!!
বর্ষাকাল আমার খুবই প্রিয়.. আমি তো বর্ষার মেয়ে, তাই বৃষ্টির সাথে আমার খুব আপন সম্পর্ক। কিন্তু এদেশের বৃষ্টিটাও বাজে! এরা অতি সন্তর্পণে ঝরবে! কেন রে বাবা! ঝমঝমিয়ে নাম না একবার!! তা নয়, টিপ টিপ করে পড়ছে। যেন একটু বেশি জোরে বৃষ্টি হলেই মাস্টারমশাই খুব বকে দেবে!
কলকাতায় অফিস যাওয়ার সময় খুব চাইতাম একটু মেঘ করুক, সেইসময় আমি অফিস পৌঁছে যাই টুক করে! আর এখানে চাইছি সূর্য উঠুক অন্তত আজকে! অনন্ত অপেক্ষা তবু সূর্য উঠছে না! সেই কবে ভারতবর্ষে সূর্যের মুখ দেখেছিলাম!
গতকাল গোটা বিশ্বে উল্কাপাত হলো, সবাই দেখলো আমি বাদে!
মেঘাচ্ছন্ন মাইন্জ!
আমার দেশের পেঁয়াজের রংটাও কি সুন্দর...কথাতেই আছে পেঁয়াজী রং! ও বাবা! এ দেশের পেঁয়াজ তো সবুজ!!!!
এতো সবুজের বহর দেখলে আমাদের দিদি ভারী খুশি হতো!
কি ভাগ্যিস গাজরের রংও সবুজ নয়!
এখানে আমি লঙ্কা অবধি মিস করছি... কারণ এরা লঙ্কা খায়না!
যদিও আমার মিস করার তালিকাটা বেশ দীর্ঘ!
সূর্য, পেঁয়াজ,চড়ুই, ফুচকা, বাসের কন্ডাক্টারের চীৎকার, অটোর লাইন, লাল পতাকার বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক স্লোগান, কাকের কা কা এমনকি মমতা ব্যানার্জ্জীকেও!!!
এমন হতচ্ছাড়া দেশ, কাক অবধি চীৎকার করে না!
হোয়াই ম্যান? হোয়াই? হোয়াই?
পায়রা আছে অনেক, সেগুলো খেয়ে খেয়ে এত্তো মোটা হয়ে গেছে! তাদের উড়তেও আলিস্যি! এক হাত উঁচু গাছে বাসা করে বসে আছে এবং অবশ্যই নো বক বকম!
মাঝেমধ্যেই প্যানপ্যান করছি এ ক্যামন দেশরে বাবা! সূর্য নেই, কাক নেই, মানুষের চীৎকার নেই! তবে আছে টা কি!!!!!
কদিন আগে ক্রীসমাস পার্টিতে গেলাম। হাই এনার্জী পার্টিকল ডিপার্টমেন্টের পার্টি! তা সেখানে সবাই বিশেষ জ্ঞানী!
চুনোপুঁটি বিজ্ঞানী থেকে আরম্ভ করে হাইফাই বিজ্ঞানী সবরকমই আছেন সেই পার্টিতে!
সেই পার্টি এমন ....কি আর বলবো! লোকে ফিসফিস করে কথা বলছে! যেন হাসপাতালে এসেছি কিংবা সদ্য সদ্য কেউ মারা গেছে! ইনফ্যাক্ট আমাদের দেশে লোক মারা গেলেও এর থেকে বেশি হৈ চৈ হয়! লোকজন চুপচাপ খেলো... তিনচারজন গিটার, পিয়ানো আর ভায়োলিন বাজালো ব্যস!!!
আমি ভাবলাম আমিই উঠে দুটো রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে দিই!
একি রে বাবা! এটা পার্টি!!! কাঁটা চামচ ছুরির টুংটাং আওয়াজ ছাড়া কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না!
সাড়ে আটটায় সকাল হয়ে চারটেই সন্ধ্যে! আমি ঘুম থেকে উঠতে না উঠতে দিন শেষ!
জানালা দিয়ে তাকাবো কি! শুধুই বৃষ্টি! কাঁহাতক আর “শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে” গাওয়া যায়!!!
সবথেকে অসুবিধা হলো কথা বলা! এরা ইংরাজী বোঝে না, বলেও না! এ এক মহা জ্বালা! কথা না বলে বলে পেট ফেঁপে যাচ্ছে!
সূর্য নেই, কাক নেই, চড়ুই নেই...গাড়ির হর্ণ নেই!
নিস্তব্ধ চরাচর... টিপটিপ পা টিপে চলা বৃষ্টির দেশ।