এইরকমই রেপুটেশন ছিলো। তবে, আমার জিনিষের ব্যাপারে আমি খুব সতর্ক থাকতাম। প্রতিদিন ইস্কুলে গল্পের বই নিয়ে যেতাম আর কাউকে ছুঁতে দিতাম না বলে অনেকে হিংসুটে বলতো। সে আমি এখনো কাউকে বই দিইনা। বই দিলে সে বই যত্ন না করে ছিঁড়ে ফেললে আমার খুব রাগ হয়। আমি বইখাতা , আমার রং তুলি, আঁকার খাতা, ডাইরী সবই ভীষণ যত্ন করে রাখতে পছন্দ করি।
সেই মেয়েই বাড়িতে বদমাস বলে পরিচিত ছিলো। এমনটা নয় যে আমি জিনিষপত্র ভাঙতাম বা ওলঢোল করতাম, তবু জানি না কেন আম্মু আমাকে হাড় জ্বালানে বলে!!! এই নিয়ে ভারী দুঃখ আমার।
আমি আসলে এতোই বই পড়তাম যে পরীক্ষার কথাও মাথায় থাকতো না। পড়ার বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই পড়াতে আমার জুড়ি ছিলো না। পড়তে পড়তে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে এই ত্রিভুবন ত্যাগ করে যেই ক্লাইমেক্সে পৌঁছতাম , অমনি আম্মু কান ধরে বইটা কেড়ে সামনে রসকষহীন পড়ার বই ধরিয়ে দিতো! সমস্যা হলো পড়ার বই পড়তে আমার কোনোদিনই ভালো লাগেনি....!!! যেই ক্লাসটা পেরিয়ে যেতো ঐ ক্লাসের বইগুলো পড়তে ভালো লাগতো। যেমন, ইতিহাস কোনোদিন ভালো লাগতো না, এখন সেই মেয়েই ইতিহাসের বই পড়তে খুব ভালোবাসে!
এই মেয়েই কিন্তু দুবছর বয়সে হাসিখুশি, বর্ণপরিচয় পড়তে শিখে গেছিলো! আমার মেজো পিসেমশাই আমার দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হয়ে বলতেন ঐটুকু মেয়ে এতো নির্ভুল পড়ছে কি করে? এতো প্রতিভা দেখে আম্মু আব্বু ভেবে নিলো মেয়ে বড়ো হয়ে কেউকেটা একটা হচ্ছেই!
তারপর একটু বড়ো হতেই আঁকা, আবৃত্তি, কুই্যজে পুরস্কার পাওয়াতে তাঁরা আরো সিওর হয়ে গেলেন!
তারপর যতো বড়ো হলো মেয়ে ততই আশা ভরসা চুরচুর করে বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে পাতি ইঞ্জিনীয়ার হয়ে নঘন্টার অফিসের কেরাণীতে পরিণত হলো সেই প্রতিভাময় কন্যা!
যাইহোক, ছোটোবেলাতে যে জিনিষটা আমি অপছন্দ করতাম সেটা কারোর ক্ষমতা ছিলো না আমার মগজে ঢোকানোর!!
নামতা!!! এতই ফাঁকিবাজ ছিলাম যে আটের ঘরের নামতার বেশি মুখস্ত করিনি! নয়ের ঘরেরটা তো এক থেকে আট মুখস্ত করলেই হয়ে যায়! আর বাকি গুণ করে বসাতাম! আম্মু শত চেষ্টা করেও মুখস্ত করাতে পারেনি!


আর একটা জিনিষ আমি অপছন্দ করতাম, তা হলো ইংরাজী! অসহ্য লাগে! এর ফলশ্রুতি আমি ইংরাজীতে বেশ কাঁচা!!!



আমার পছন্দ কি ছিলো জানো? পুতুলখেলা!
আমার দশ বারোটা পুতুল ছিলো.... এখনো আছে। নীল চোখের চোখ পিটপিট পুতুল। না , বার্বি নয়। ক্লাস টেনের জন্মদিনে আম্মু প্রথম বার্বি উপহার দেয়, সাদা পোষাক পরা খ্রীশ্চান নববধূ। আমার পুতুলের নামও ছিলো.... কেটি, অ্যালিস, হাইডি, রাহুল, এলিস , রাইন ইত্যাদি ।
আমার খেলনা বাটিও ছিলো কত রকমের, প্লাস্টিকের, তামার, স্টিললের , মাটির !!! চামচ সেট, গ্যাস ওভেন, থালা, গ্লাস আরো কতকি। আম্মু কাঠের মিস্ত্রি দিয়ে পুতুলের ড্রেসিং টেবিল, খাট কতকি বানিয়ে দিয়েছিলো। আমি পুতুলের জামা বানাতে ভালোবাসতাম। বর্ধমান শহরের যত নামি দর্জি আছে তাদের কাছে গিয়ে গিয়ে বেঁচে যাওয়া কাপড়ের টুকরো এনে সুন্দর সুন্দর পোষাক বানাতাম। হাতে সেলাই করে। আমার একটা খাতা ছিলো যাতে আমি পোষাক ডিজাইন করতাম। তারপর, সেলাই করে জামা বানাতাম! আমার অনেক ইচ্ছের মধ্যে একটা ইচ্ছে ছিলো ফ্যাশন ডিজাইনার হবো।
তারপর যা হয় আরকি! ছোটোবেলার অগণিত স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয়েই ঘুরে বেড়ায় আমাদের মধ্যে! পৃথিবীতে কিছু ইচ্ছে পূর্ণ না হওয়া বড্ডো দরকার, তবেই না আমরা বেঁচে থাকার রশদ পাবো। এখনো আমার কেটি, অ্যালিসরা আছে, বড়ো একটা সিন্দুকের মধ্যে। আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কালের ক্রমে। আর আমার বুকের ভিতরটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় একটু একটু করে। আমার শৈশব লুকিয়ে আছে ঐ পুতুল, গল্পের বই, ছোটোবেলার ছবি আর আম্মুর মুখের গল্পে। আমি অনুভব করি একটু একটু করে, প্রাণ ভরে বাঁচি ঐ সময়টাতে এখনো।
আস্তে আস্তে আমার শৈশবের গন্ধ মাখানো সব জিনিষ নষ্ট হয়ে যাবে, শুধুমাত্র আমি থাকবো.... তারপর আমিও একদিন স্মৃতি হয়ে যাবো। এটাই নিয়ম জগতের.....
আমি শুধু আমার মেয়েকে ঐ নীল চোখ ওলা চোখ পিটপিট পুতুল আর গল্পের বই দিয়ে যাবো একরাশ। যাতে সে আমারি মতো একরাশ স্মৃতি বানিয়ে যেতে পারে নিজের জন্য, অন্যের জন্য।