Monday, 8 June 2015

বৃষ্টিবিলাস১

-- আমি যখন ছোট্ট ছিলাম
খেলতে যেতাম মেঘের দলে...
প্রতিটা মানুষের জীবনে বৃষ্টি একটা আলাদা স্থান পেয়েছে। প্রতিটা বাঙালি মেয়ের মতো বৃষ্টি আমারও সতীন। আমি দুয়োরাণী আর সে সুয়োরাণী। বৃষ্টি ভীষণভাবে প্রিয় রামগড়ুরের ছানার। কোনো এক মূহুতের্ আবেগপ্রবণ হয়ে তার এই স্বীকারোক্তি। ভীষণ হিংসা হয়েছিল। এখনো হয়।
কিন্তু তাকে হিংসা করে কি থাকা যায়? আমার শৈশব, আমার কিশোরীবেলার সঙ্গী । কোনো এক বৃষ্টিবেলায় উতল হাওয়ায় ওড়া চুল আর বৃষ্টির পরশে আমার হটাৎ জেগে ওঠা মেয়েবেলা।
বৃষ্টি মানেই তখন লোডশেডিং। ব্যাটারিতে জ্বলা মায়াভরা হলুদ আলো। আমাদের বাড়িতে তখন জেনারেটর ছিলো না। তখন জানতাম শুধুমাত্র বড়োলোকরাই ব্যবহার করে জেনারেটর। এখনো নেই অবশ্য। সে যাইহোক, ব্যাটারির আলো খুববেশি হলে এক ঘন্টা চলতো। তারপর বই খাতা গুটিয়ে হুল্লোড়,আমরা তিন ভাইবোন। চলতো আন্তাক্ষরী। শ্রোতা আব্বু,আম্মু,দাদি সব্বাই। মাঝেমধ্যে আম্মু গান ধরিয়ে দিতো। না পারলে বিপক্ষ এক পয়েন্ট পাবে। কচি গলায় গেয়ে উঠতাম "শ্যামল শোভন শ্রাবন তুমি নাই বা গেলে।"
কখনো কখনো আব্বুর সাথে রাক্ষস রাক্ষস খেলা। আব্বুর পুরো শরীরটা বালিশ দিয়ে ঢেকে দিতাম। আব্বু চুপ করে শুয়ে থাকতো আর কিছুক্ষণ পর লাফিয়ে উঠে আমাদের ভয় দেখাতো হাউ মাউ খাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ। আর হাত বাড়িয়ে আমাদের ধরার চেষ্টা করতো, আমরা দৌড়ে পালিয়ে যেতাম। এতেই কি আনন্দ!
শহরের বৃষ্টি আর গ্রামের বৃষ্টির দিনের মধে্য অনেক পাথর্ক্য। আমাদের বধর্মানের বৃষ্টির দিন মানে দাদাভাইয়ের বাজার করে আনা একরাশ সব্জি দিয়ে বানানো গরম খিচুড়ি, সঙ্গে ডিমভুনা আর বাড়িতে বানানো ঘি। রেনি ডে হলে সেদিন কি মজা। চলতো পুতুল খেলা, আমার মেয়ে পুতুল..জুঁইয়ের ছেলে পুতুলের বিয়ে.. কিন্তু আমার মেয়েকে আমি মোটেই শ্বশুরবাড়ি পাঠাবোনা! আমি ঘর জামাই করে রাখতাম জুঁইয়ের ছেলেকে! বেচারা জুঁই বউমার জন্য শাড়ি গহনা মিষ্টি পাঠিয়ে ক্লান্ত।
নাহলে রেনকোট পড়ে ইসকুল। গায়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে আর জলতরঙ্গের সুর তুলছে।
আব্বুর উটকো শখে আমাকে সবুর স্যারের কাছে বাংলা পড়তে যেতে হয়েছিল কিছুদিন। ভোর ছটায় পড়া। বেচারা জুঁই সাড়ে পাঁচটায় রেডি হয়ে আমাদের বাড়ি চলে আসতো। আমাকে ঘুম থেকে তুলতে! আম্মু,আব্বু আর জুঁইয়ের প্রাণান্ত চেষ্টায় সাড়ে ছটায় স্যারের বাড়ি। স্যার হলেন আমার দেখা একমাত্র অতি ধার্মিক যে কিনা সাহিত্যের লোক।
কামিজ পরা নিয়ে জ্ঞান দিতেন । আমি তখন হাঁটু অবধি অ্যালান ফ্রক নইলে স্কার্ট পরি।
জুঁই তখন সদ্য কৈশোরে পা রাখার অহংকারে সালোয়ার কামিজ পড়ছে। রানি কালারের উপর সাদা ফুটকি পি্রন্ট। কে অতো জ্ঞান শুনবে স্যারের! তার থেকে আমি ঢের বেশি ইন্টারেসটেড, স্যারের বাড়ির সামনে বষর্ায় গজানো কচিসবুজ কলমি বন নিয়ে। হাল্কা বেগুনি কলমি ফুল, মৌমাছি,প্রজাপতি ছেড়ে কে পড়াশোনা করে! জুঁইয়ের পড়া শেষ হলে হোমটাস্ক আর হাতভরে কলমি ফুল নিয়ে সোজা বাড়ি। তারপর গোসল করে খেয়েদেয়ে ঝিমঝিম বৃষ্টিতে রেনকোট পরে ইসকুলের পথে।
আমাদের স্কুলটা অনেক পুরোনো। বড়ো বড়ো খড়খড়ি দেওয়া জানালা। বেশি বৃষ্টির সময় ছাঁট আটকাতে জানালা গুলো বন্ধ করে দেওয়া হতো। অন্ধকার ক্লাস রুম,একটা গা ছম্ছমে ব্যাপার, তার মধে্য আমাদের জলসা। সুরেলা,রিনি এরা দারুণ গান গাইতো, কখনো আমি আবৃত্তি করতাম। রবি ঠাকুরের সংকলিতা থেকে "বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর, নদেয় এলো বান",কখনোবা সঞ্চয়িতা থেকে "গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা"!
ক্লাস ফাইভ অবধি স্কুলবাসে । তিন নম্বর বাস। আমাদের বাড়িটা এমন জায়গায় ছিলো যে ইসকুল যাওয়ার সময় লাস্ট স্টপ আর ইসকুল থেকে ফেরার সময় ফার্স্ট স্টপ। তারপর হঠাত্ করে একদিন শৈশব পেরিয়ে কৈশোর। বৃষ্টির দিনে ইসকুল থেকে ফেরার পথে সাইকেল ,ভেজা শাড়ি আর ঝাপসা হয়ে আসা চশমা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি আসা। রেনকোট পড়েও কাকভেজা । বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে ফেলে আসা সোনার শৈশব।

No comments:

Post a Comment