Monday, 7 November 2016

শৈশবের গন্ধ মাখানো শৈশব

আমি বরাবরেই ফাঁকিবাজ ছাত্রী। যাকে বলে সিরিয়াস টাইপ ফাঁকিবাজ। তবে ইস্কুলে পড়াটড়া করে যেতাম, মানে ঐ টুকুই পড়াশোনা করতাম আরকি যেটুকু না হলেই নয়। বাড়িতে আম্মু বাঁদর মেয়ে বলতো আর ইস্কুলে দিদিমণিরা বেশ লক্ষী মেয়ে বলতেন। আমাদের ইস্কুলে দুজন ক্লাস মনিটর থাকতো। তারা অফপিরিয়ডে দায়িত্ব নিয়ে আমাদের চুপ করিয়ে রাখতো যাতে আমাদের মাছের বাজারের কারণে বাকি ক্লাসের ডিসটার্ব না হয়। যারা কথা বলতো তাদের নাম বোর্ডে লেখা হতো আর পরের ক্লাসে দিদিমণি এসে তাদের শাস্তি দিতেন। ক্লাস সেভেনে একবার আমার নাম বোর্ডে উঠে গেছিলো, ভৌতবিজ্ঞানের কবিতা দিদিমণি খুব অবাক হয়ে আমাকে বলেছিলেন তুইও কথা বলেছিস? দুষ্টুমি করেছিস?
এইরকমই রেপুটেশন ছিলো। তবে, আমার জিনিষের ব্যাপারে আমি খুব সতর্ক থাকতাম। প্রতিদিন ইস্কুলে গল্পের বই নিয়ে যেতাম আর কাউকে ছুঁতে দিতাম না বলে অনেকে হিংসুটে বলতো। সে আমি এখনো কাউকে বই দিইনা। বই দিলে সে বই যত্ন না করে ছিঁড়ে ফেললে আমার খুব রাগ হয়। আমি বইখাতা , আমার রং তুলি, আঁকার খাতা, ডাইরী সবই ভীষণ যত্ন করে রাখতে পছন্দ করি।
সেই মেয়েই বাড়িতে বদমাস বলে পরিচিত ছিলো। এমনটা নয় যে আমি জিনিষপত্র ভাঙতাম বা ওলঢোল করতাম, তবু জানি না কেন আম্মু আমাকে হাড় জ্বালানে বলে!!! এই নিয়ে ভারী দুঃখ আমার।
আমি আসলে এতোই বই পড়তাম যে পরীক্ষার কথাও মাথায় থাকতো না। পড়ার বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই পড়াতে আমার জুড়ি ছিলো না। পড়তে পড়তে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে এই ত্রিভুবন ত্যাগ করে যেই ক্লাইমেক্সে পৌঁছতাম , অমনি আম্মু কান ধরে বইটা কেড়ে সামনে রসকষহীন পড়ার বই ধরিয়ে দিতো! সমস্যা হলো পড়ার বই পড়তে আমার কোনোদিনই ভালো লাগেনি....!!! যেই ক্লাসটা পেরিয়ে যেতো ঐ ক্লাসের বইগুলো পড়তে ভালো লাগতো। যেমন, ইতিহাস কোনোদিন ভালো লাগতো না, এখন সেই মেয়েই ইতিহাসের বই পড়তে খুব ভালোবাসে!
এই মেয়েই কিন্তু দুবছর বয়সে হাসিখুশি, বর্ণপরিচয় পড়তে শিখে গেছিলো! আমার মেজো পিসেমশাই আমার দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হয়ে বলতেন ঐটুকু মেয়ে এতো নির্ভুল পড়ছে কি করে? এতো প্রতিভা দেখে আম্মু আব্বু ভেবে নিলো মেয়ে বড়ো হয়ে কেউকেটা একটা হচ্ছেই!
তারপর একটু বড়ো হতেই আঁকা, আবৃত্তি, কুই্যজে পুরস্কার পাওয়াতে তাঁরা আরো সিওর হয়ে গেলেন!
তারপর যতো বড়ো হলো মেয়ে ততই আশা ভরসা চুরচুর করে বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে পাতি ইঞ্জিনীয়ার হয়ে নঘন্টার অফিসের কেরাণীতে পরিণত হলো সেই প্রতিভাময় কন্যা!
যাইহোক, ছোটোবেলাতে যে জিনিষটা আমি অপছন্দ করতাম সেটা কারোর ক্ষমতা ছিলো না আমার মগজে ঢোকানোর!!
নামতা!!! এতই ফাঁকিবাজ ছিলাম যে আটের ঘরের নামতার বেশি মুখস্ত করিনি! নয়ের ঘরেরটা তো এক থেকে আট মুখস্ত করলেই হয়ে যায়! আর বাকি গুণ করে বসাতাম! আম্মু শত চেষ্টা করেও মুখস্ত করাতে পারেনি! 😂😂
আর একটা জিনিষ আমি অপছন্দ করতাম, তা হলো ইংরাজী! অসহ্য লাগে! এর ফলশ্রুতি আমি ইংরাজীতে বেশ কাঁচা!!! 😂😂😂
আমার পছন্দ কি ছিলো জানো? পুতুলখেলা!
আমার দশ বারোটা পুতুল ছিলো.... এখনো আছে। নীল চোখের চোখ পিটপিট পুতুল। না , বার্বি নয়। ক্লাস টেনের জন্মদিনে আম্মু প্রথম বার্বি উপহার দেয়, সাদা পোষাক পরা খ্রীশ্চান নববধূ। আমার পুতুলের নামও ছিলো.... কেটি, অ্যালিস, হাইডি, রাহুল, এলিস , রাইন ইত্যাদি ।
আমার খেলনা বাটিও ছিলো কত রকমের, প্লাস্টিকের, তামার, স্টিললের , মাটির !!! চামচ সেট, গ্যাস ওভেন, থালা, গ্লাস আরো কতকি। আম্মু কাঠের মিস্ত্রি দিয়ে পুতুলের ড্রেসিং টেবিল, খাট কতকি বানিয়ে দিয়েছিলো। আমি পুতুলের জামা বানাতে ভালোবাসতাম। বর্ধমান শহরের যত নামি দর্জি আছে তাদের কাছে গিয়ে গিয়ে বেঁচে যাওয়া কাপড়ের টুকরো এনে সুন্দর সুন্দর পোষাক বানাতাম। হাতে সেলাই করে। আমার একটা খাতা ছিলো যাতে আমি পোষাক ডিজাইন করতাম। তারপর, সেলাই করে জামা বানাতাম! আমার অনেক ইচ্ছের মধ্যে একটা ইচ্ছে ছিলো ফ্যাশন ডিজাইনার হবো।
তারপর যা হয় আরকি! ছোটোবেলার অগণিত স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয়েই ঘুরে বেড়ায় আমাদের মধ্যে! পৃথিবীতে কিছু ইচ্ছে পূর্ণ না হওয়া বড্ডো দরকার, তবেই না আমরা বেঁচে থাকার রশদ পাবো। এখনো আমার কেটি, অ্যালিসরা আছে, বড়ো একটা সিন্দুকের মধ্যে। আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কালের ক্রমে। আর আমার বুকের ভিতরটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় একটু একটু করে। আমার শৈশব লুকিয়ে আছে ঐ পুতুল, গল্পের বই, ছোটোবেলার ছবি আর আম্মুর মুখের গল্পে। আমি অনুভব করি একটু একটু করে, প্রাণ ভরে বাঁচি ঐ সময়টাতে এখনো।
আস্তে আস্তে আমার শৈশবের গন্ধ মাখানো সব জিনিষ নষ্ট হয়ে যাবে, শুধুমাত্র আমি থাকবো.... তারপর আমিও একদিন স্মৃতি হয়ে যাবো। এটাই নিয়ম জগতের.....
আমি শুধু আমার মেয়েকে ঐ নীল চোখ ওলা চোখ পিটপিট পুতুল আর গল্পের বই দিয়ে যাবো একরাশ। যাতে সে আমারি মতো একরাশ স্মৃতি বানিয়ে যেতে পারে নিজের জন্য, অন্যের জন্য।

ডাক্তারবাবু এবং আমি

কদিন ধরেই শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। গত সপ্তাহে অফিসে পাঁচ মিনিটের জন্য ধরাধাম ত্যাগ করেছিলাম। সে যাইহোক, ডাক্তারের কাছে গেছি। ডাক্তারবাবু সাংঘাতিক মজার লোক। লাস্টবার যখন গেছিলাম, তখন পোষ্ট ব্রেক আপ সমস্যা চলছিলো। ডাক্তারবাবু আমাকে তাঁর জীবনের ল্যাং খাওয়ার গল্প শুনিয়েছিলেন... যে যাত্রায় ওনার ওষুধ আর ল্যাং খাওয়ার গল্পের সৌজন্যে ট্রমা থেকে বের হয়েছিলাম!!!
এবার, যাওয়ার পরেই উনি জিজ্ঞাসা করলেন সমস্যা কি?
আমি বলার আগেই আমার আম্মু যাবতীয় অভিযোগের ঝুলি নিয়ে বসলেন...
আমি খুব কনফিউজড হয়ে ভাবছিলুম ডাক্তারের কাছে এসেছি নাকি টিচারের কাছে!!!
নেহাৎ ওনার কাছে ডান্ডা ফান্ডা নেই, নইলে আমি সিওর আম্মু ওনাকে রিকুয়েষ্ট করতেন বেশ কয়েক ঘা বসাতে!!
এতো বড়ো ধেড়ে একটি মেয়ের সম্পর্কে যে অ্যাতো অভিযোগ থাকতে পারে, সেটা আমার আম্মুকে না দেখলে বিশ্বাস করা বেশ কঠিন!!
"একদম কথা শোনে না, এতো রাগ মেয়ের ! আপনি কিছু করুন!"
আমি বুঝলাম না আমি কথা শুনি না বা রাগ করি এতে ডাক্তার বাবুর করণীয় কি!!!
বেশ জ্বালায় পরা গেলো তো!
আমি এবার থাকতে না পেরে বলে উঠলাম "আচ্ছা মুসকিল তো!!! তুমি চুপ করবে একটু?
ডাক্তারবাবু আপনিই বলুন এতো বড়ো একটা মেয়ের সব ব্যাপারে নাক গলালে মাথা গরম হবে না? অফিসের ফোন এলেও ওনাকে বলতে হবে কে ফোন করেছে , কি বললো!!!
কিছু বললেই বলবে 'আমি তোর মা, আমার অধিকার সবথেকে বেশি!! আমি জানবো না তো কে জানবে' ! মাথা গরম হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?"
ডাক্তারবাবু বলে উঠলেন "সত্যিই তো কতো বড়ো হয়ে গেছে! নাক না গলালেই কি নয়?"
আমি ভাবলাম, যাক বাবা আমার হয়েই কথা বলছে!!!
ওমা, সে গুড়ে বালি.... তিনি সংযোজন করলেন " এখনকার জেনারেশনটাই হলো ডিফেক্টিভ, নিজেরাও কাঁদবে অন্যকেও কাঁদাবে!! পুরো জেনারেশনটাই ডিফেক্টিভ জন্ম নিয়েছে।
শোনো মা বাবার কাছে সন্তান কখনো বড়ো হয়না! তুমি যখন মা হবে বুঝতে পারবে!"

বাপ মা হলেই এই বিখ্যাত কথার পেটেন্ট পাওয়া যায় "মা/বাপ হও , তখন বুঝবে!"
বেগতিক দেখে চুপ করে গেলুম। পৃথিবীর সব মা, বাপ একজোট হয়ে যায় সন্তানের বদনাম করার ব্যাপারে! এখন যদি কিছু বলি বলা তো যায় না ইঞ্জেকশন ফুটিয়ে দিলো! আমি আবার ভীষণ ভয় পাই। এদের বিশ্বাস নেই, ছেলেপুলেদের টাইট দেওয়ার ব্যাপারে সব সমান!!
থার্মোমিটারে টেম্পারেচার দেখে , পেট টেপে টুপে, অ্যাঁ করে বের করা জিভ খানিক দেখে শুনে বললেন জ্বর আছে, প্রেশারটাও বেশ লো আছে। সর্দিও আছে.... ভাইরাল মনে হচ্ছে। জল খায়না তাই না?
আমি তো পুরোই কোণঠাসা!!! মোক্ষম জায়গাতে মেরেছে ডাক্তার!!!
এবার আম্মুর চীৎকার আরো বেড়ে গেলো। ডাক্তারবাবু একদম পানি খায়না!! খাবারও খায়না! নইলে এই বয়সে লো প্রেশার হয়?আমি পইপই করে বলেছিলাম পানি না খেলে শরীর খারাপ হবে!!!
ব্যাপার হলো পৃথিবীর সব মায়েরা স্বঘোষিত ডাক্তার হয়! এরা সর্দি, কাশি , বমি সবের ডাক্তারিতে সিদ্ধহস্ত!!!
কি আর করা যাবে, চুপ করেই রইলুম! মনে মনে ভাবছি "হর কুত্তেকা দিন আতা হ্যায়"
যাইহোক, পানি না খেলে স্যালাইন দেওয়ার হুমকি দিয়ে ডাক্তারবাবু পাঁচদিন পরে আবার আমার পদধূলি চেয়েছেন ওনার চেম্বারে!
এই কদিন পানি খেতেই হবে, নইলে ডাক্তারবাবু আর আম্মুর ষড়যন্ত্রে স্যালাইন থেকে কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না!!!

ভালো আছি, ভালো থেকো।

অফিসে লবিতে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখ ছলছল। তার সহকর্মীর সাথে গল্প করছে....তার এক প্রিয় মানুষের মৃত্যুর কথা। রবিবার রাতে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে...মেয়েটির চোখ থেকে ঝরঝর করে জল পরছে...গলায় আকুতি কেন আমার সাথেই কেন?
আমি বড্ডো স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করলাম। কথাটা শুনে কানে হেড ফোন গুঁজে মুখ ফিরিয়ে চলে এলাম। কিছুই বলার ছিলো না....কি বলতাম? সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার কাছে.....সমবেদনা আমি জানাতে পারিনা...
প্রিয় মানুষের হারানোর বেদনা বুঝি.... শুধু আমি কেন , এই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ বোঝে।
যে মানুষটাকে চোখের সামনে হাসতে, খেলতে দেখতো.... সে হঠাৎ করে একদিন নেই.... কোথাও নেই....মন খারাপ করলেও কিছু করার নেই... সে এই পৃথিবীর কোথাও নেই। এই কষ্ট অদ্ভূত রকম কষ্ট।
সেই মানুষটা নেই জীবনে... কিন্তু অন্তত সে এই পৃথিবীতে আছে... হাসছে,খেলছে....ভালো আছে।
হোক না, তার সাথে হয়তো কখনো দেখা হবে না...কোনোদিন ফোনের স্ক্রীণে নং ভেসে উঠবে না...কিন্তু তবু তো মনে শান্তি,বেঁচে আছে, ভালো আছে।
অন্তত পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষগুলোর মতো অন্য জগতে চলে যায়নি সে।
গাড়িটা চলছে তীব্র গতিতে নীল সাদা ফ্লাইওভার পেরিয়ে....সাঁই সাঁই করে পেরিয়ে যাচ্ছে প্রিয় কলকাতা। হেডফোনে গান বাজছে ...জানালা দিয়ে দমকা হাওয়া এসে চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে...কাঁচটা তুলে দিলাম।

পৃথিবীটা বড্ড সুন্দর।
ভালোবাসে বা ঘৃণা করে অথবা কিছুই করে না এমন সব মানুষেরা ভালো থাকুক...এই পৃথিবীরই অন্য কোথাও তারা থাকুক...বেঁচে থাকুক।
সময় বদলায়...মানুষের সম্পর্ক গুলো বদলায়...
একটা সময় পরে বুকের খিঁচখিঁচ অনুভবটা কমে যায়.... অতীত হয়ে স্মৃতিগুলোই রয়ে যায়। একটা সময় পরে ঐ স্মৃতিগুলোর উপরে সময়ের ধূলো জমবে.... ঝাপসা হয়ে যাবে পুরোনো অতীত, নতুন অতীতের কাছে।
একদিন হয়তো হাসি মুখে অতীত বর্তমানের সামনে দাঁড়াবে, সেদিন পুরোনো অতীতের গা থেকে সময়ের ধুলো ঝেড়ে আরো একবার অনুভব করবো পুরোনো সময়টাকে।
ভালো আছি, ভালো থেকো।

ইয়ে সাম যবভি আয়েগি তুম হামকো ইয়াদ আয়োগে...

একটি সপ্তদশী কিশোরী কলকাতা শহরে পা রেখেছিলো... প্রিয় জন্মশহরকে ছাড়তে তার প্রচুর কষ্ট হয়েছিলো... কিছুতেই ভালোবেসে উঠতে পারেনি কলকাতাকে।
নোংরা, ঘিঞ্জি , ভীড়ে ঠাসা কলকাতা তার শহর কখনোই নয়, কোনোদিন সে মনের এক কোণে কলকাতাকে স্থান দেবে না, কিছুতেই নয়।
তারপর নয় বছর কেটে গেছে...গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল...জীবন থেকে চলে গেছে অনেকটা সময়, মনে হয় যেন কত যুগ আগের কথা। পিছনে তাকিয়ে দেখতে পাই কত স্মৃতি জমে গেছে ফেলে আসা জীবনের আনাচে কানাচে।
এই নোংরা শহরটা বড্ড আপন হয়ে গেছে.... পুরোনো রাজপথ, নীল সাদা গ্রীলে ঢাকা ফুটপাত, নিয়ন আলো, ভিখারী সবাই আমার ভীষণ প্রিয়।
এত বছরেও কলকাতাকে সেই ভাবে চিনে উঠতে পারিনি, কেন পারিনি তার পিছনেও রয়েছে অনেক স্মৃতি। তার পরেও মেট্রোর প্রতিটা স্টেশনে, চওড়া রাস্তায় আছে কিছু না কিছু মূহুর্ত লুকিয়ে। যখন সেই স্মৃতি বিজড়িত রাস্তায় নামি তারা এসে মনের ভিতর হাঁকডাক করে...
কলেজ স্ট্রীট আমার কেন এই কলকাতার সব মানুষের প্রিয় একটা জায়গা... কফিহাউস, প্যারামাউন্ট, ট্রামলাইন, অটো সব কিছুই বড়ো প্রিয়।
আমি সবসময়ই চাইতাম কলকাতার সব পুরোনো ইতিহাসকে একবার ছুঁতে, একবার অনুভব করতে। পুরোনো কলকাতার পুরোনো বাড়ির ছাত, জানালা , খড়খড়ি, জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া কড়ি বরগা সবকিছুই আমার অসাধারণ লাগে। মনে হয়, আমার যদি এইরকম পুরোনো বড়ো বারান্দাওলা একটা বাড়ি থাকতো? লম্বা ছাত, যে বাড়ির আনাচে কানাচে যার ইতিহাস লুকোনো... যে বাড়ি সাক্ষী থেকেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের, নকশাল আন্দোলনের....যারা সাক্ষী প্রচুর ন্যায়-অন্যায় , বিচার-অবিচারের... ! তাহলে একবার ছুঁয়ে দেখতাম , সেই বাড়ির বারান্দায় বা ছাতে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে ভাবতাম সেইসব দিনগুলোর কথা যখন ভোর রাতে কলকাতার রাজপথ ধোয়া হতো....টুনটুন বেল বাজিয়ে ট্রাম যেতো...পুরোনো কলকাতা শহর।
দেবরিনা আর আমি হাঁটছি কলেজ স্ট্রীট ধরে.... ফুটপাত শুনশান রবিবারের ছুটির বাজারে।
কলেজ চত্বর ফাঁকা.... পুঁটিরামের দোকানের বিখ্যাত কচুরি দিয়ে শুরু করলাম , তারপর প্যারামাউন্টের ডাব সরবত, কেশর লস্যি , মৌচাকের রসালো মৌচাক মিষ্টি, কেশর পিস্তা সন্দেশ খেয়ে স্মৃতি বিজড়িত কফিহাউস।
এক কোণের টেবিলের কাছে গিয়ে বসলাম দুজনে... কত রকমের লোকজন ... সবাই আলোচনা করছে কতরকম.... কেউ কাব্য, কেউ কবিতা, রাজনীতি কতকি। পাশের টেবিলে একজন বৃদ্ধ বসে এক মনে কিছু লিখছেন...লিখেই চলেছেন... কে জানে উনি কে... হয়তো কোনো কবি কিংবা লেখক...
খানিক পরে উঠে চলে গেলেন, পরণে পাঞ্জাবি আর ঝোলা ব্যাগ।
হঠাৎ পাশের টেবিলে একজনের ফোনে রিং বেজে উঠলো...
"আজীব দাস্তা হে ইয়ে
কাহা শুরু কাহা খতম...
ইয়ে মঞ্জিলে হ্যায় কৌনসি
না ওহ সমঝ সাকে না হাম...."
স্মৃতি কখনো পিছু ছাড়ে না....। কোনো এক ফেব্রুয়ারি মাসে অষ্টাদশী কোনো এক মেয়ের সাথে কোনো এক মানুষের প্রথম দেখা হয়েছিলো এই কফিহাউসেই....তখনো ফোনে রিংটোন বেজেছিলো "আজীব দাস্তা হ্যায় ইয়ে!"
আমি আর দেবরিনা দুজনেই কফি ঠান্ডা করে খাই। দুজনেই স্মৃতির অতলে... চারপাশে হাজার মানুষ দেখছি, তাদের নিয়ে গল্প করছি... পুরনো স্মৃতির মধ্য থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন মূহুর্ত যারা কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে।
স্মৃতি জন্ম নিতেই থাকে প্রতি মূহুর্তে, আর একটু একটু করে আমরা বড়ো হয়ে উঠি...একটা সময় পরে স্মৃতির ভারে ক্লান্ত হয়ে আমরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিই। সেই স্মৃতিরা ইতিহাস হয়ে রয়ে যায় পুরোনো বাড়ি, রাস্তার আনাচে কানাচে।
হেয়ার স্কুল, হিন্দু স্কুল, সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল, প্রেসিডেন্সি, মেডিক্যাল কলেজ , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের প্রতিটা রাস্তায় আমরা হাঁটছি। হাল্কা বাতাস বইছে....ইতিউতি লোকের জটলা... হৈ চৈ...
আকাশে এত্তোবড়ো সোনালী একখানা চাঁদ... নিয়ন আলো আর জ্যোৎস্না মিলে মিশে এক হয়ে গেছে।
আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই, ইচ্ছে করছে না মূহুর্তটাকে ছাড়তে..সেই কলকাতাকে ঘৃণা করা মেয়েটা আজকে কলকাতাকে বড়ো ভালোবাসে। কলকাতা তাকে অনেক কিছু দিয়েছে ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, ঘৃণা, শিক্ষা, স্মৃতিতে ভরপুর একটা জীবন দিয়েছে।
গভীর রাত নামছে একটু একটু করে, বাড়ি ফিরতে হবে। পিছনে পড়ে আছে ইতিহাস, স্মৃতি , বহুকাল আগের বড়ো বারান্দায় দাঁড়ানো লাল পাড় সাদা শাড়ী পরা কিশোরী কন্যা....একশো বছর আগের কোনো চাঁদনী রাতের মতোই আজকের রাত... জীবন এগিয়ে চলে ইতিহাস রেখে।
গানটা এখনো কানে বাজছে
"ইয়ে সাম যবভি আয়েগি
তুম হামকো ইয়াদ আয়োগে.....!"

Tuesday, 21 June 2016

পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা বোর্ড এবং রাজ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

মাদ্রাসা মানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি একটি আরবি শব্দ । অনেকের ধারণা মাদ্রাসাতে শুধুই জঙ্গী উৎপাদন হয় এবং অনেকের ধারণা মাদ্রাসাতে না পড়লে সহি মুসলিম হওয়া যায়না।
মাদ্রাসা কি ধরণের এসব আলোচনায় আমি আপাতত যাচ্ছি না।
তবে জেনে রাখা ভালো প্রচুর মাদ্রাসা আছে যেগুলি সরকারি অনুদার প্রাপ্ত এবং নথীভুক্ত। এগুলির পাঠ্যক্রম বড়ো বড়ো শিক্ষাবিদরাই করে থাকেন এবং এগুলি বিজ্ঞান সম্মত। (যারা জানতে চান তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা বোর্ডের সিলেবাস দেখে নেবেন একটু দয়া করে।)
যদিও মাদ্রাসার কথাটির সাথে ধর্মীয় লেনদেন কিছু নেই তবুও অস্বীকার করা যায়না যে এই মাদ্রাসাগুলি ভারতীয় মুসলিম সমাজের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে এবং এখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মুসলিম।
অবশ্যই হিন্দু শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীও আছে তবে সংখ্যায় কম , কারণ উপরোক্ত কারণে এটিকে মুসলিদের প্রতিষ্ঠান বলেই ধরা হয়।
এবার আসল কথায় আসি।
আমি মাদ্রাসা এবং রাজ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পৃথকীকরণের বিপক্ষে।
কেন একজন শিক্ষার্থীকে ধর্মের ট্যাগ দেওয়া হবে শিশুকালেই? কেন একটা মাদ্রাসায় একজন অন্য ধর্মের মানুষ ভর্তি হতে ভয় পাবে কারণ তাদের ধারণা সেখানে শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়? কেনই বা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হবে? কেনই বা মাদ্রাসা বোর্ড বলে একটি পৃথক বোর্ড করে বুঝিয়ে দেওয়া হলো ঐ প্রতিষ্ঠান মুসলিমদের জন্য? আমি এই মেরুকরণের তীব্র প্রতিবাদ করি। ছোটো বেলা থেকেই শিশু মনে হিন্দু, মুসলিম, খ্রীশ্চান এই কথাগুলো ঢোকানোর তীব্র প্রতিবাদ করি।
আমি মনে করি মাদ্রাসা বোর্ড এবং রাজ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলিকে এক ছাতার তলায় আনা উচিত। সংস্কৃতের পাশাপাশি আরবী , ফার্সী ভাষাও রাখা হোক সব স্কুলে বাধ্যতামূলক ভাবে। যার যে ভাষা শেখার ইচ্ছে, সে সেটাই শিখবে। মুসলিম বলে আরবি শিখতে হবে বা হিন্দু বলে সংস্কৃত এই মেরুকরণের শিক্ষা বন্ধ হোক। একজন মুসলিম চাইলে সংস্কৃত এবং একজন হিন্দু চাইলে আরবী শিখতেই পারে। কারণ ভাষার কোনো ধর্ম হয়না।
দরকার পরলে গরীব শিক্ষার্থীদের ভর্তুকি দেওয়া হোক যাতে সে শিক্ষা লাভ করার উৎসাহ পায়।

সেইসব দিনগুলো

একটি সপ্তদশী কিশোরী কলকাতা শহরে পা রেখেছিলো... প্রিয় জন্মশহরকে ছাড়তে তার প্রচুর কষ্ট হয়েছিলো... কিছুতেই ভালোবেসে উঠতে পারেনি কলকাতাকে।
নোংরা, ঘিঞ্জি , ভীড়ে ঠাসা কলকাতা তার শহর কখনোই নয়, কোনোদিন সে মনের এক কোণে কলকাতাকে স্থান দেবে না, কিছুতেই নয়।
তারপর নয় বছর কেটে গেছে...গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল...জীবন থেকে চলে গেছে অনেকটা সময়, মনে হয় যেন কত যুগ আগের কথা। পিছনে তাকিয়ে দেখতে পাই কত স্মৃতি জমে গেছে ফেলে আসা জীবনের আনাচে কানাচে।
এই নোংরা শহরটা বড্ড আপন হয়ে গেছে.... পুরোনো রাজপথ, নীল সাদা গ্রীলে ঢাকা ফুটপাত, নিয়ন আলো, ভিখারী সবাই আমার ভীষণ প্রিয়।
এত বছরেও কলকাতাকে সেই ভাবে চিনে উঠতে পারিনি, কেন পারিনি তার পিছনেও রয়েছে অনেক স্মৃতি। তার পরেও মেট্রোর প্রতিটা স্টেশনে, চওড়া রাস্তায় আছে কিছু না কিছু মূহুর্ত লুকিয়ে। যখন সেই স্মৃতি বিজড়িত রাস্তায় নামি তারা এসে মনের ভিতর হাঁকডাক করে...
কলেজ স্ট্রীট আমার কেন এই কলকাতার সব মানুষের প্রিয় একটা জায়গা... কফিহাউস, প্যারামাউন্ট, ট্রামলাইন, অটো সব কিছুই বড়ো প্রিয়।
আমি সবসময়ই চাইতাম কলকাতার সব পুরোনো ইতিহাসকে একবার ছুঁতে, একবার অনুভব করতে। পুরোনো কলকাতার পুরোনো বাড়ির ছাত, জানালা , খড়খড়ি, জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া কড়ি বরগা সবকিছুই আমার অসাধারণ লাগে। মনে হয়, আমার যদি এইরকম পুরোনো বড়ো বারান্দাওলা একটা বাড়ি থাকতো? লম্বা ছাত, যে বাড়ির আনাচে কানাচে যার ইতিহাস লুকোনো... যে বাড়ি সাক্ষী থেকেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের, নকশাল আন্দোলনের....যারা সাক্ষী প্রচুর ন্যায়-অন্যায় , বিচার-অবিচারের... ! তাহলে একবার ছুঁয়ে দেখতাম , সেই বাড়ির বারান্দায় বা ছাতে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে ভাবতাম সেইসব দিনগুলোর কথা যখন ভোর রাতে কলকাতার রাজপথ ধোয়া হতো....টুনটুন বেল বাজিয়ে ট্রাম যেতো...পুরোনো কলকাতা শহর।
দেবরিনা আর আমি হাঁটছি কলেজ স্ট্রীট ধরে.... ফুটপাত শুনশান রবিবারের ছুটির বাজারে।
কলেজ চত্বর ফাঁকা.... পুঁটিরামের দোকানের বিখ্যাত কচুরি দিয়ে শুরু করলাম , তারপর প্যারামাউন্টের ডাব সরবত, কেশর লস্যি , মৌচাকের রসালো মৌচাক মিষ্টি, কেশর পিস্তা সন্দেশ খেয়ে স্মৃতি বিজড়িত কফিহাউস।
এক কোণের টেবিলের কাছে গিয়ে বসলাম দুজনে... কত রকমের লোকজন ... সবাই আলোচনা করছে কতরকম.... কেউ কাব্য, কেউ কবিতা, রাজনীতি কতকি। পাশের টেবিলে একজন বৃদ্ধ বসে এক মনে কিছু লিখছেন...লিখেই চলেছেন... কে জানে উনি কে... হয়তো কোনো কবি কিংবা লেখক...
খানিক পরে উঠে চলে গেলেন, পরণে পাঞ্জাবি আর ঝোলা ব্যাগ।
হঠাৎ পাশের টেবিলে একজনের ফোনে রিং বেজে উঠলো...
"আজীব দাস্তা হে ইয়ে
কাহা শুরু কাহা খতম...
ইয়ে মঞ্জিলে হ্যায় কৌনসি
না ওহ সমঝ সাকে না হাম...."
স্মৃতি কখনো পিছু ছাড়ে না....। কোনো এক ফেব্রুয়ারি মাসে অষ্টাদশী কোনো এক মেয়ের সাথে কোনো এক মানুষের প্রথম দেখা হয়েছিলো এই কফিহাউসেই....তখনো ফোনে রিংটোন বেজেছিলো "আজীব দাস্তা হ্যায় ইয়ে!"
আমি আর দেবরিনা দুজনেই কফি ঠান্ডা করে খাই। দুজনেই স্মৃতির অতলে... চারপাশে হাজার মানুষ দেখছি, তাদের নিয়ে গল্প করছি... পুরনো স্মৃতির মধ্য থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন মূহুর্ত যারা কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে।
স্মৃতি জন্ম নিতেই থাকে প্রতি মূহুর্তে, আর একটু একটু করে আমরা বড়ো হয়ে উঠি...একটা সময় পরে স্মৃতির ভারে ক্লান্ত হয়ে আমরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিই। সেই স্মৃতিরা ইতিহাস হয়ে রয়ে যায় পুরোনো বাড়ি, রাস্তার আনাচে কানাচে।
স্কটিশচার্চ কলেজ, আশুতোষ কলেজ, হিন্দু স্কুল, সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল, প্রেসিডেন্সি, মেডিক্যাল কলেজ , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের প্রতিটা রাস্তায় আমরা হাঁটছি। হাল্কা বাতাস বইছে....ইতিউতি লোকের জটলা... হৈ চৈ...
আকাশে এত্তোবড়ো সোনালী একখানা চাঁদ... নিয়ন আলো আর জ্যোৎস্না মিলে মিশে এক হয়ে গেছে।
আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই, ইচ্ছে করছে না মূহুর্তটাকে ছাড়তে..সেই কলকাতাকে ঘৃণা করা মেয়েটা আজকে কলকাতাকে বড়ো ভালোবাসে। কলকাতা তাকে অনেক কিছু দিয়েছে ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, ঘৃণা, শিক্ষা, স্মৃতিতে ভরপুর একটা জীবন দিয়েছে।
গভীর রাত নামছে একটু একটু করে, বাড়ি ফিরতে হবে। পিছনে পড়ে আছে ইতিহাস, স্মৃতি , বহুকাল আগের বড়ো বারান্দায় দাঁড়ানো লাল পাড় সাদা শাড়ী পরা কিশোরী কন্যা....একশো বছর আগের কোনো চাঁদনী রাতের মতোই আজকের রাত... জীবন এগিয়ে চলে ইতিহাস রেখে।
গানটা এখনো কানে বাজছে
"ইয়ে সাম যবভি আয়েগি
তুম হামকো ইয়াদ আয়োগে.....!"