Thursday, 2 May 2019

অভিমান

প্রথম যখন জিন্স পরি ক্লাস এইটে কি সেভেনে পড়ি। বোন অবশ্য বরাবরই ফ্যান্সি। তিনি তার আগেই জিন্স পরতেন। তা তখন ব্যাপারটা অন্য রকম ছিলো। ক্লাস সিক্স মানে এবার ফ্রক বন্ধ করে চুড়িদারে যাওয়াটাই নিয়ম ছিলো। আমরা দু বোন যথারীতি ক্লাস সিক্সেও বড়ো হয়ে উঠতে পারলাম না। মানে রোগা পাতলা প্যাঁকাটি শরীরে সেই পুঁচকেই লাগি! আম্মুও ফ্রক কেনা বন্ধ করলো না। ওদিকে তখন টিউশনে পাড়ার বন্ধুরা চুড়িদার পড়ছে। তখন মার্কেটে কুচকুচ হোতা হ্যায় হেবি হিট। কাজলের সেই লাল চুনরি সাদা চুড়িদারে মহিলা মহল বিশেষ করে আমাদের মতোন উঠতি ছানাপোনারা বিশালভাবে আকৃষ্ট।
সবাই সাদা চুড়িদারের সাথে লাল ওড়না নিয়ে নিজেদের কাজল ভাবছে। আমিও ভাবার চেষ্টা করলাম.. বাদ সাধলো মাইনাস সিক্সের পেল্লাই চশমা। কালো ফ্রেমের গোলগোল চশমা লোকজনের কাছে হাস্যকর একটা বিষয় ছিলো। পাড়ার ছেলেপুলেরা যখন বাকি কিছুতে পেরে উঠতো না তখন চারচোখো, চশমিস ইত্যাদি বলে খেপাতো। আমিও কেমন জানি তখন এই চশমা পরাটাকে বাজে ভাবে দেখতাম... সবাই কি সুন্দর কাজল, আইলাইনার পরে আর আমার সব ঢেকে যায় ছাই চশমাতেই। বিচ্ছিরি... একেবারে বিচ্ছিরি।
অথচ আমি ছোটো থেকে কি সুন্দর সোজা ভাবে আইলাইনার পরতে পারতাম.. একটুও হাত কাঁপতো না। জুঁই, নিউ সবাই আমার কাছেই আইলাইনার পরতো... আর সেই আমিই কিনা আইলাইনার পরে কাউকে দেখাতে পারছিনা, সব চশমাতে ঢাকা পরে যাচ্ছে!
সবুর স্যারের কাছে বাংলা আর ইংরাজী পড়তে যেতাম। তিনি আবার ধার্মিক মানুষ। সকাল সন্ধে আমাকে চুড়িদার পরার উপদেশ দিতেন.. আর অ্যালান ফ্রক পরা আমি বিরক্ত হয়ে স্যারের ঘরের উঠোনের কলমীশাকে বেশী মনোযোগ দিতাম। স্যার ওদিকে ঘরে পড়াচ্ছেন... এদিকে আমি উঠোনে বর্ষার সজীব লকলকে কলমী শাক, তার গোলাপী ফুল আর মৌমাছি নিয়ে ব্যস্ত।
পড়াশুনো করে কে আর সময় নষ্ট করে!!! যতটুকু দরকার তার বেশী পড়াশোনা করা আমার ধাতে নেই। তাহলে কুকুরছানা, বেড়ালছানা, শালিখ পাখি, পায়রাদের সময় কে দেবে?
যাগগে, যখন জিন্স পরতে শুরু করি ত্রিভুবনে আত্মীয়দের মধ্যে কেউ জিন্স পরেনা। আব্বু মেয়েকে জিন্স পরতে দেখে এক সপ্তাহ কথা বন্ধ করে দিলো... তারপরের সপ্তাহে অবশ্য তাস খেলতে বসে গেছে মেয়েদের সাথে! তখন দশটায় পড়াশোনা শেষ করে আমরা তিনভাইবোন আর আব্বু একঘন্টা তাস খেলতাম। আম্মু চীৎকার করতো “এমন বাপ যে ছেলেদের পড়তে বসতে না বলে তাস খেলতে বলছে”... তারপর একসময় বিরক্ত হয়ে বলতো “ভাত দিচ্ছি.. খেয়ে দেয়ে আমাকে উদ্ধার করো!”
যাগগে, জিন্স পরিহিত মেয়েদের দেখে আনাচে কানাচে ঘুষঘুষে কথা.... ‘কাজী সাহেব বেঁচে নেই তাই মেয়েগুলো এসব অসভ্য জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বেঁচে থাকলে ঠান্ডা করে দিতেন এতো সাহস ইত্যাদি প্রভৃ নানারকম বক্তব্য।’
কাজীসাহেব হলেন আমার দাদা... লোকের ধারণা ছিলো উনি বেঁচে থাকলে আমার এতো সাহস হতো না। আমার অবশ্য উল্টো ধারণা... ওনার কারণেই আমি এতো সাহসী। আমিই বোধহয় প্রথম যে ওনার চোখে চোখ রেখে তর্ক করতাম… উনি শেষে যুক্তিতে না পেরে বিরক্ত হয়ে বলতেন বড়ো হয়ে জজ হবি! কিন্তু উনি কখনোই আমাকে বারণ করেননি তর্ক না করতে… কিংবা বলা যায় অতিরিক্ত স্নেহের কারণে আমাকে বাগে আনতে পারেননি। দাদার স্বভাব ছিলো কাউকে ভয় না পাওয়া… আমারও খানিকটা হলেও ঐ স্বভাব আছে।
ওনার ধারণা ছিলো জামাতী-তবলিগের লোকেরা অধিকাংশই ধান্দাবাজ হয়… বেশী ধর্মকর্ম করা লোক উনি পছন্দ করতেন না। একবার আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের পীর হওয়ার গল্প শুনে বলেছিলেন “ও কবে আবার পীর হলো? ওতো কংগ্রেসী গুন্ডা! যত্তসব!”
যাগগে, যা বলছিলাম.. তো মোটামুটি এবার আব্বু আম্মুকে শুনতে হচ্ছে মেয়েকে মানুষ করতে পারোনি। মেয়ে মানে আমি আরকি… যাকে ফরমাশ করলে মুখের উপর বলে নিজে নিয়ে পানি খাও। মুখের সামনে পানি ধরার মতো সময় নেই।
যে সারাদিন বই পড়ে আর কিছু হলেই লেকচার দেয়। অতএব এই রকম একটা ধারণা হলো এতো বেশি বই পড়ার কারণেই অসভ্য মেয়ে হয়েছি।
একবার আমার এক ফুফুমণির বাড়িতে এক বিয়েতে গেছি। বিয়ে শেষে ফিরবো গাড়িতে… তা ফুফুমণির বাড়ি সে চব্বিশ পরগণার দূর এক গ্রামে… বর্ধমান থেকে অনেক দূর, তাই আবার জুনমাসের প্যাচপেচে গরম। অতএব আমরা দুবোনেই জিন্স পরেছি। ফুফুমণির এক আত্মীয় ছিলেন সাংঘাতিক রিগ্রেসিভ… মেয়েদের কি করা উচিত কি করা উচিত নয় তার উপর লেকচার দিচ্ছেলেন। আমিও খুব তর্ক করছি।
শেষে উনি বললেন মেয়ে শিক্ষিত হয়েছে বটে, কিন্তু মানুষ হয় নাই।
ফুফুমণিও বললেন যে আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সামনে নাক কেটে দিলি… এখানে জিন্স পরার কি দরকার ছিলো ইত্যাদি প্রভৃতি।
যতই বোঝানো হোক যে জিন্স তো সারাক্ষণ পরেনি এই বাড়ি যাওয়ার সময় পরেছে রাস্তায় যাতায়াতের সুবিধার জন্য… তিনি মানতেই নারাজ।
আজ অবশ্য ওনার মেয়েও জিন্স পরে… বিদেশে থাকে। অবস্থা মানুষকে অনেকটাই বদলিয়ে দেয় আরকি।
আব্বুকে কতবার কতজন বলেছে মেয়েদের এতটা বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়..
একবার আমার আব্বুর এক খালাতো ভাই বলেছিলো মেয়েকে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়িওনা ভাই… ও লাইন খারাপ। ভদ্রলোকের মেয়েদের জন্য না।
যাগগে, আমার আব্বু লোকের কথায় বিশেষ কান দিতো না এই রক্ষে… বরং আম্মু দুদিন মন খারাপ করে বসে থাকে যে লোকে বলছে মেয়ে মানুষ করতে পারিনি ইত্যাদি প্রভৃতি … তারপর আবার উৎফুল্ল হয়ে যায়।
সেই ভদ্রলোকের দুটো মেয়ে… তিনি মেয়েদের ইঞ্জিনীয়ার কিংবা ডাক্তার করবেন ভেবেছেন। ঐ একই কথা অবস্থা মানুষকে বদলিয়ে দেয় কিংবা পরের ছেলে পরমানন্দ, যত উচ্ছন্নে যায় তত আনন্দ!
তা এখন দেখি আত্মীয় স্বজনদের মেয়েরা অনেকেই জিন্স পরে… ভালোই লাগে। সমাজ এগোচ্ছে… আমরা যে প্রতিকূলতা পার হয়েছি সেইটা পরবর্তী প্রজন্ম যেন অনুভব না করে।
অনেকদিন পরে একটা ঢপের লেখা লিখলাম আরকি… হঠাৎ মনে পরে গেলো। অভিমান বেরিয়ে যাওয়া ভালো… ভিতরে রয়ে যাওয়া কাজের কথা না।

পরিচিত মেয়েদের সত্যিকারের গল্প

এই সপ্তাহে পরিচিত কিংবা স্বল্পপরিচিত মেয়েদের সত্যিকারের গল্প লিখবো ঠিক করেছি। প্রথম গল্প খুবই ছোটো। 
মেয়েটি সম্পর্কে আমার মাসি হয়। যদিও আমার থেকে অনেকটাই ছোটো। আমার আম্মুর এক দূর সম্পর্কের মামার মেয়ে। একদিন সম্ভবত কোনো এক রবিবার হবে, কারণ আমি সেদিন বর্ধমানে,বিকেলের দিকে নানাভাই এলেন মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে। এটা সেটা নানারকমের গল্প চলছে... পাত্রপক্ষ নাকি খুবই ভালো...বংশ ভালো, বড়োলোক, বর্ধমানের বড়োবাজারে দোতলা বাড়ি।একটাই ছেলে..ব্যবসা আছে.. কিছু একটা চাকরিও করে সম্ভবত ...ঠিক মনে পরছে না। আমি যা জিজ্ঞাসা করি সাধারণ তাই করে ফেললাম... “হবু বরের গল্প তো বহু শুনলাম...এবার একটু হবু বউয়ের গল্প শুনি!!!”
নানাভাই হেলে বললেন “এই তো মেয়ের ঊনিশ বছর বয়স.. সেকেন্ড ইয়ারে উঠলো।”
আমি খুবই অবাক হয়ে বললাম “এখনি বিয়ে দেওয়ার কি দরকার ছিলো? গ্রাজুয়েশনটা অন্তত করা উচিত ছিলো।এতো কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বয়স কম থাকলে মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত বেশী হয়... বিয়ে ভাঙার চান্সও বেশী থাকে।”
পাশ থেকে বিব্রত আম্মু বলে উঠলো.. “এইসব কথা বলে এই সময়?”
আমি বললাম “যা সত্যি, সেটাই বলছি। এখনো সময় আছে... পরে কিছু হলে আফসোসের সীমা থাকবে না।”
নানাভাই বললেন “মামণি, সবাই কি তোমার মতো পড়াশোনায় ভালো হয়? আমার মেয়ে বোকা সোকা, শান্ত মানুষ… সাত চড়ে রা কাটে না… তাছাড়া পড়াশোনায় ভালো না। এই বাজারে ঐ পড়াশোনায় চাকরি পাবে না।”
আমি তখন বেশ বিরক্ত... একটু রেগেই বললাম “পড়াশোনায় সবাই ভালো হবে এমনটা নয়... তা বলে আপনি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট না করেই বিয়ে দিয়ে দেবেন? কিছু ভাবুন না ভাবুন অন্তত পরবর্তী প্রজন্মের কথাটা ভাবুন।
আমিও পড়াশোনায় আহামরি নই, কিন্তু আমার আব্বু আম্মু হতাশ হয়ে চেষ্টা ছেড়ে দেয়নি... তাই আজকে আমি একটা চাকরি অন্তত করছি। যদি বাপ মাই আশা ছেড়ে দেয় তাহলে কি করে হবে?”
যাগগে...তারপরেও বিয়ের নেমন্তন্ন হলো... বিয়েও হয়ে গেলো! 
তারপর ছয় সাত মাস পরের কথা। হঠাৎ শুনি মায়ের ঐ মামা এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গন্ডগোল শুরু হয়েছে…মেয়েকে নাকি মারধোর করা হয়, ঠিক মতো খেতে দেওয়া হয়না… সারাদিন ঘরের দরজায় তালা মেরে রাখে শাশুড়ি যাতে দিনের বেলা বউ ঘুমোতে না পারে। কাজের মেয়েও ছাড়িয়ে দিয়েছে… শুধু তাই নয় বরের নাকি অন্য কোনো মেয়ের সাথে প্রেম আছে। মেয়েটা সেসব জেনে ফেলাতে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেছে। 
এতকিছু হওয়ার পরেও মেয়ে কিন্তু বাপের বাড়িতে কিছু বলেনি। ঐ যে ভারতীয় নারী…মরে যাবে তবু শ্বশুরবাড়ীর বদনাম মুখ ফুটেও করবে না! 
কিন্তু বাদ সেধেছে শরীর… প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরেই বাপের বাড়ীর নজরে আসে বিষয়টা। তারপরেই সব জানাজানি…
নানাভাই আবার একদিন এসেছিলেন… আমি তখন বর্ধমানে। 
আমাকে দেখেই বললেন “তুমি ঠিক বলেছিলে মা। তখন যদি তোমার কথায় কান দিতাম আজ এই দিন দেখতে হতো না। আমি খুব ভুল করেছি।”
এরপরে সম্ভবত মেয়েটা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে.. আর তারপরে নিজের গ্রামেরই এক গরীব ছেলের সাথে বিয়ে হয়। ছেলেটার পরিবার খুব অবস্থাপন্ন না হলেও ছেলেটা কিছু একটা করে…যাতে এখন অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। 
শুনছি মেয়েটা আপাতত খুবই সুখে আছে। 
আসলে জীবনে বংশ, টাকা, স্টেট্যাস ইত্যাদিই সব নয়… সবথেকে দরকারি ভালো থাকা আর ভালো রাখা। 
অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যে কতটা সমস্যার সেটা অভিভাবকদেরই বুঝতে হবে। ভালো ছেলের সন্ধান সবসময়ই পাওয়া যাবে… না পাওয়া গেলেও অসুবিধা নেই, কারণ বিয়েটাই জীবনের সবকিছু না। মেয়েদের শিক্ষিত করাটা, নিজের পায়ে দাঁড় করানোটা খুব জরুরী… তাহলেই সমাজের এই নারী নির্যাতনের মতো সমস্যাগুলো অনেকাংশেই কমবে বলে আমার ধারণা।
আর একটা কথা কোনো এক মহাপুরুষ বলে গেছেন.. একটা ছেলে শিক্ষিত হলে শুধু সেই শিক্ষিত হয়… কিন্তু একটা মেয়ে শিক্ষিত হলে পরের পুরো প্রজন্ম শিক্ষিত হয়। মেয়েদের শিক্ষিত হওয়াটা বহু জরুরী... অন্তত পৃথিবীর জন্য... মানুষের জন্য। বাকিসব না হয় বাদই দিলাম।

ঝুলন

এসব হলো সেই কালের কথা, যখন রাখী পূর্ণিমা রকষাবন্ধন হয়নি, দোলপূর্ণিমা হ্যাপি হোলি হয়নি।
তখন রাখীপূর্ণিমা হওয়ার একমাস আগে থেকে পাড়ায় পাড়ায় ঝুলন সাজানো হতো.. চলতো রাখী শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেও। বাচ্চারা মাটি, পুতুল, শ্যাওলা, গাছপালা দিয়ে ঝুলন সাজাতো।
বিশেষ করে পাড়ায় বিহারী বাড়ি যেদিকে আছে সেদিকে বেশী করে ঝুলন দেখা যেতো। রাস্তার ধারের ঝোলা বারান্দা কিংবা ড্রেনের উপরের স্ল্যাবে বাচ্চারা হরেক কিসিমের ঝুলন সাজাতো। নয়ন স্যারের বাড়ির সামনে সব্জিবাজারের মুখটাতে, পুশিদিদিমণির বাড়ি সামনে, পার্কাস রোডে সারসার ঝুলনের পশরা সাজাতো বাচ্চারা... আর রাস্তা দিয়ে কেউ গেলেই পয়সা চাইতো। দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা.. কেউ কেউ আবার এক টাকাও দিতো।
তেঁতুলবাজারের মোড়ের মাথায় বর্ষামঙ্গল দোকানের ঠিক সামনে মুচীকাকুর পাশেই ঝুলনের পশরা নিয়ে দোকানদার বসতো সার সার। মাটির পুতুল, মাটির খেলনা হাঁড়ি কুরি সে অনেক কিছু। মাটির বাঘ, গরু,ছাগল থেকে আরম্ভ করে রামকৃষ্ণ, সারদামা অবধি পাওয়া যেতো।
আমি সারাবছর অপেক্ষা করে থাকতাম ঝুলনের সময়টার জন্য। এই সময়েই খেলনাপাতির সবথেকে সুন্দর মাটির হাঁড়ি, শেণি, থালা বাসন, কড়াই পাওয়া যেত।
শেণি সমেত হাঁড়ি নিলে এক টাকা দাম... সেই হাঁড়ির গায়ে লাল হলুদ রঙের নক্সা। দাদাভাই মাটির খেলনা কিনে দিত অনেক রকমের। আর দুইবোনের দুটো হাঁড়ি... আমি আবার ওতে সন্তষ্ট নই...আমার একখান কড়াইও চাই। আমি খেলনাবাটি খেলতে খুব ভালোবাসতাম।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাড়ির বাইরে খেলা করা আমাদের মানা ছিলো.. পাড়ার মধ্যে শুধু জুঁইদের বাড়ি যেতাম.. কখনো কখনো ফুচুদের বাড়ি.. খুব ছোটো বেলায় রামিজদের বাড়িও যেতাম। আধঘন্টার বেশী বাড়ির বাইরে থাকলে দাদাভাই চেঁচামেঁচি করতেন। অগত্যা সবাই আমাদের বাড়িতে এসেই খেলতো... কেউ না এলে আমরা তিনভাই বোনেই খেলতাম।
ঝুলন বানাতে বালি লাগে... আমাদের একতলার বাথরুমের পাশে তখন বালি ডাঁই করে রাখা থাকতো.. আমাদের ফুলটুসী মুরগীটা ঐ বালিতে খেলা করতো। ফুলটুসীর মতো সুন্দর মুরগী আমি আর এজন্মে দেখলাম না। হাল্কা কালচে গোলাপী পালকের উপর সোনালী রং এর ছটা। আমার এই প্রিয় মুরগী কলকে পাতা খেয়ে একদিন ধুম করে মরে গেলো। আমি এক সপ্তাহ কেঁদেছিলাম। ফুলটুসী নিয়ে বহু গল্প আছে... সেই গল্প আর একদিন হবে।
যাইহোক, বালি ছাদে নিয়ে এসে বালির বেস করে, তারপর সিনারী সাজানোর পর্ব চলতো। গ্রামবাংলা সাজানোই সবথেকে সহজ... অতএব কলার পাতা সমেত মাটির বাড়ি বসিয়ে সেই বাড়ির সামনে লম্বা লাল সুরকির রাস্তা। ইঁট ঘষে সুরকি বানানো হতো... হলুদ সুরকি, লাল সুরকি, খয়েরী সুরকি।
গাছপালা সাজানোর জন্য ফুলটা, ছোটো ছোটো গাছ আনতে যেতাম আঙুরদার পার্কে। ওখানে অনেক রকমের ফুলগাছ আছে। তারপর তা দিয়ে বাগান, প্লাস্টিকের বাটি বালি দিয়ে ঢেকে তাতে জল দিয়ে পুকুর। আমার তিনচার খানা কালো টুপী পরা হলুদ প্লাস্টিকের হাঁস ছিলো... টিকটিকির ডিম চকোলেট ভরা ছিলো হাঁসগুলোর পেটে.. ওদের ভাসানোর চেষ্টা চলতো পুকুরের.. পুকুরের অনুপাতে হাঁস বড়ো! পুকুরের চারপাশে শ্যাওলার প্রলেপ.. তখন আমাদের বাড়ির পাঁচিলে অনেক শ্যাওলা হতো.. আর লুচিপাতা গাছ, হলদে ফুল ওলা কুকুর শোঁকা গাছও অনেক হতো। কুকুর শোঁকা ফুল কেন বলা হতো জানিনা.. তবে সবাই বলতো।
যাগগে, ঝুলন তো সাজানো হলো। কিন্তু আমাদের ছাতে এসে আর কে ঝুলন দেখবে!! টাকা পয়সাও পাওয়া যাবে না! কি দুঃখ , কি দুঃখ। অগত্যা আম্মু, আব্বু, দাদি, দাদা সবাইকে টেনে এনে ঝুলন দেখাতাম... দাদা টাকা দিয়ে দিতেন। একটাকা, দুটাকা কিংবা পাঁচটাকা! দাদি আর আব্বু দিতো না! আমার আব্বুর কাছে তখন টাকা পাওয়া বিশাল ব্যাপার... তাও এমনি এমনি দিতো না। একটা পাকা চুলে দশপয়সা দিতো! তখন বেশী পাকা চুল নেই, আর টাকাও নেই! আমি মনে মনে বলতাম আব্বুর চুলগুলো সব পাকা করে দাও আল্লাহ! সে শখ আর পূর্ণ হতো না।
এখন আব্বুর অনেক চুল পেকে গেছে... এখন আর এক টাকায় একটা ইক্লেয়ার কিংবা পঞ্চাশ পয়সায় হাঁস মুরগীওলা টিকটিকির ডিমও পাওয়া যায়না।
এখনকার বাচ্চারা ঝুলনও সাজায় না আর!
তারা এখন ক্যান্ডিক্রাশ আর ফিফা খেলে!
আমাদের ছোটোবেলাগুলো বড়ো রঙিন ছিলো... জলরং এ আঁকা রঙিন স্বপ্নের মতো ..

ফুলটুসী: দ্বিতীয় পর্ব

ফুলটুসীকে তো বগলে করে বর্ধমানের বাড়িতে নিয়ে এলাম। ফুলটুসী বেজায় অবাক। এ আবার কোথায় এলাম রে বাবা! গাছ নেই, ঘাস নেই, মাটি নেই, আকাশ আছে বটে তা সেই ছাদে উঠলেই শুধু দেখা যায়... আজব পৃথিবী। 
প্রথম কদিন ফুলটুসীকে বেঁধে রাখা হলো... দুদিন পরে ফুলটুসী দিব্যি ঘর চিনে গেলো। অনিতা সিনেমা লেন থেকে ফুলটুসীর জন্য ফল রাখার কাঠের বাস্কেট আনা হলো। আজ থেকে ফুলটুসীর দরমা ঐটায়। ফুলটুসী মন খারাপ হয়েছিলো কিনা জানিনা... মুরগীরা বোধহয় কাঁদে না, মন খারাপ করেনা... কিংবা করে কে জানে! ফুলটুসী কিন্তু দিব্যি মানিয়ে নিলো বর্ধমানে। যখন মন হতো টুকটুক করে ছাদে চলে যেতো। সকাল বেলা কুঁক কুঁক করতে করতে একতলা থেকে দোতলায় চলে আসতো দিব্যি... দাদি আর আম্মু রান্নার জন্য সব্জি কাটছে, মাছ কুটছে... ফুলটুসী মনের আনন্দে ফেলে দেওয়া কানকো, লাউয়ের খোসা খাচ্ছে।
লোকে বলে ছাগলে কিনা খায়... আমি বলি মুরগীতে কিনা খায়... মুরগীকে মুরগীর মাংস দিলেও খেয়ে নেবে সোনা মুখ করে।
সেই ফুলটুসীকে হঠাৎ একদিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না...হঠাৎ করেই। আমি তো হাত পা ছড়িয়ে চীৎকার করে কাঁদছি...
নীচে থেকে দাদা দৌড়ে চলে এসেছেন "কি হলো বড়কির ? কাঁদছে কেন? কে মেরেছে? আয় আয় আমার কাছে আয়... কারোর কাছে যেতে হবেনা। আমি তোমাকে অনেক মুরগী কিনে দেবো বুবু... কাঁদে না।"
তারপর আম্মু আর দাদির দিকে রেগে বললেন.. "তখন থেকে মেয়েটা কাঁদছে! দ্যাখো না মুরগীটা গেলো কোথায়!"
আমার দাদা ছিলেন খুব রাগী... সবাই খুব ভয় পায় , যাকে বলে থরহরিকম্প। এমনকি বিকেলে দাদার কাছে ফলের খোসা খেতে আসা ছাগলেরাও দাদাকে ভয় পায়। একবার দাদার শরীর খুব খারাপ... খারাপ মানে যাকে বলে যাচ্ছেতাই খারাপ। পাড়ার
লোকজন সবাই জড়ো হয়ে গেছে... পার্টি অফিস থেকে লোকজন দৌড়ে চলে এসেছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার, ডাক্তার সে এক হৈ চৈ ব্যাপার। আমার ছোটো ফুফাজান কোথা থেকে একখান কোরআন শরীফ এনে দাদার মাথার কাছে পড়তে শুরু করে দিলেন। সবাই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে... এখুনি মরে যাবে দাদা।
আমার খুব মনখারাপ... দাদা সত্যিই মরে যাবে?
এমন সময় দাদা হুঙ্কার দিয়ে উঠলো... "দূর হয়ে যাও সব এখান থেকে! ইয়ার্কি হচ্ছে অ্যাঁ? আমি এখনি মরছিনা । ওসব কোরাণ শরীফ নিয়ে দূর হয়ে যাও আমার দুচোখের সামনে থেকে!"
সেই চীৎকার শুনে কোরাণ শরীফ নিয়ে ফুফাজান প্রায় খাট থেকে পড়ে যায় যায় অবস্থা! একরকম দৌড়ে পালিয়ে বাঁচেন! এদিকে ঘরও প্রায় ফাঁকা হয়ে গেলো সেই হুঙ্কারে!
একমাত্র প্রাণী যে দাদাকে ভয় পায়না সে হলো আমি! দাদার মুখে তর্ক, দাদাকে বকা প্রায় সবই আমি করি। দাদাকে প্রশ্ন করে তিতিবিরক্ত করে দিই...বিরক্ত হয়ে দাদা বলেন "জজব্যারিস্টার হবে বড়ো হয়ে, উফ! জানটা খারাপ করে দিলে বকে বকে!!! দূর হয়ে যাও চোখের সামনে থেকে"
আমার সেই রাগী দাদাই এখন আমাকে কোলে করে ভোলাচ্ছেন!
নানাভাই এসেছেন সেইসময়। আমার নানাভাই শিল্পী মানুষ... অসাধারণ ছবি আঁকেন। শান্ত শিষ্ট ধবধবে ফরসা কমকথা বলা একটা লোক... হাঁপানির রুগী ।
তিনিও শশব্যস্ত হয়ে মুরগী খুঁজছেন। বাড়ির সবাই মুরগী খুঁজতে ব্যস্ত। প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেছে... আম্মু প্রায় নিশ্চিত কুকুর কিংবা বিড়ালে ফুলটুসীকে মেরে ফেলেছে! এমন সময় কি মনে হতে ছাদের সিঁড়ি ওঠার চাতালে পড়ে থাকা অ্যালুমিনিয়ামের গামলাটা তুলতেই দেখে ..অজ্ঞান ফুলটুসী!
ছাদে যেতে গিয়ে ডানার ঝাপটে কোনোভাবে সে গামলা চাপা পড়ে গেছে... তারপর আর বেরোতে পারেনি! আধঘন্টা চাপা থেকে অক্সিজেনের অভাবে তার এই দশা!
আমি তো ফুলটুসীর ঐ অবস্থা থেকে আরো কান্নাকাটি জুড়েছি। আম্মু তখন ফুলটুসীকে নিয়ে এসে দাদির ঘরে ফ্যানের তলায় রেখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে, পানি খাওয়াচ্ছে। প্রায় মিনিট পনেরো পরে টলতে টলতে ফুলটুসী উঠে দাঁড়ালো... আমি জড়িয়ে ধরলাম আমার ফুলটুসীকে।
তারপর থেকে ফুলটুসীর যাতায়াতের রাস্তায় বালতি, গামলা কিছুই রাখা হতো না। সে নিশ্চিন্তে একতলা থেকে ইচ্ছামতো ছাদে যেতো।
(চলবে)

ফুলটুসী - ১

আমার একটা দেশী মুরগী ছিলো, নাম ফুলটুসী। ঐরকম সুন্দর মুরগী আমি জীবনে আর একটা দেখলাম না। হাল্কা বেগুনি রঙের দেহ আর গলায় সোনালী পালক। 
ফুলটুসী ছিলো আমার প্রথম পোষ্য যার কারণে আমি বহুবছর মুরগী খাওয়া বন্ধ রেখেছিলাম। 
তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে পড়ি। মামারবাড়ি গেছি গরম কিংবা পুজোর ছুটিতে ঠিক মনে নেই। তখন মামারবাড়ি ছিলো রূপকথার রাজ্য। নানাভাই নানীজান মামারা...আমবাগান, কাঁঠানবাগান, পুকুর ঘাটে রূপচাঁদা মাছ আর দামোদরের চর। 
আমরা শ্যালোতে গা ধুতাম হুল্লোড় করে...একবার গায়ে বিছুটি ঘষে গেছিলো! সে কি কান্ড... হু হা করে হাত জ্বলছে।আমরা তত লাফাচ্ছি পানির মধ্যে। 
শ্যালোর পানি প্রচন্ড ঠান্ডা হতো... কাঁচের মতো পরিস্কার... সেই পানি তিরতির করে আল বেয়ে চলে যেতো ধানক্ষেতে। 
তো এমন মামারবাড়িতে গেলে কে আর ফিরতে চায় কাঠলোহার শহরে? 
কিন্তু ফিরতে হবেই। আব্বু নিতে এসেছে... ভোর পাঁচটায় সবকটাকে ঘুম থেকে তুলে দিলো। আব্বু তখন কেমন যেন হিটলার টাইপ ছিলো... নইলে ওতো ভোরে কে বাড়ি যায়? অমি হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছি... বাড়ি যাবো না। আরো দিন কয়েক থাকবো। ঐদিকে আব্বু হাতের নড়া ধরে হিড়হিড় করে টানছে। মোষের গাড়ি সেজেগুজে রেডি। নানিজানের চোখে পানি। নানিজান সান্ত্বনা দিচ্ছে আবার চলে আসবে বুবু... কাঁদে না। 
হঠাৎ আমার চোখ পড়লো পাঁচিলের দিকে। আমার ফুলটুসি (তখনো নামকরণ হয়নি) পাঁচিলে গলা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে... সকালের নরম আলো সোনালী পালকে পরে চকচক করছে। দেখে আমি মুগ্ধ। ব্যস, আর যায় কোথা! অজুহাত রেডি। 
আমি ডিক্লেয়ার করলাম ঐ মুরগী ছাড়া আমি কোত্থাও যাবো না। সবাই হতবাক। ছাড়া মুরগী ধরা এক কঠিন কাজ। নানিজান বললো আগে জানলে আমি দরমাতেই আটকে রাখতাম। এদিকে আমি মুরগী ছাড়া বাড়ি যাবো না। অতএব নানাভাই মুনিশদের হুকুম দিলেন মুরগী ধরার জন্য। সবাই মুরগী ধরতে ব্যস্ত। মুরগী দৌড়ায়, পিছনে লোকজন দৌড়ায়.. শেষে বহুকষ্টে মুরগী ধরা পড়লো.. তারপর মুরগীকে প্যাকেটে ভরে, শুধু মুখটা থলি থেকে বের করে আমাকে দেওয়া হলো। আমি মুরগী বগলদাবা করে মোষের গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলো...মোষের গলায় ঘন্টা টুনটুন করে বাজছে। শিং এ প্লাস্টিকের মালা জড়ানো। 
ওদিকে মুরগীর নামকরণ কমপ্লিট। ফুলটুসীর বুক তখন ধড়ধড় করছে ভয়ে... আমি মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস দিয়ে চলেছি। 
বাসে জানালার ধারে বসে.. সারাবাসের লোক অবাক হয়ে দেখছে ফ্রক পড়া পুঁচকি একটা মেয়ে কোলে মুরগী নিয়ে বসে.. 
সাঁই সাঁই করে বাস চলেছে বর্ধমানের পথে, ফুলটুসীর নতুন বাড়িতে। 
(চলবে)

কর্মজীবি নারীদের দিনে

ক্লাস এইটে ওঠার পরে গ্রামের স্কুল থেকে অন্য গ্রামের স্কুলে যেতে হবে বলে বাড়ি থেকে পড়াশোনা ছাড়িয়ে দেয়... অতোটা রাস্তা... রাস্তাটাও ভালো না। বাড়ি আসতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। বিয়ের জন্য কথাবার্তাও শুরু হয়। একবছর কান্নাকাটি জোর জবরদস্তি করে পাশের গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয় মেয়েটি। অভাবের সংসারে মেয়ে হয়ে নতুন বই কিংবা টিউশন নেওয়ার অাশা স্বপ্ন। অন্যের কাছে বই চেয়ে পড়াশোনা করে শেষঅবধি কলেজ পাশ করে।
চাকরি করা হয়ে ওঠেনি শেষ অবধি। চাকরি করা যাবেনা এই শর্তে স্বচ্ছল ঘরের একমাত্র পুত্রবধূ হয়ে এসেছিলো সেই মেয়ে। তারপর তার কাজ হয় নিজের মেয়েদের বড়ো করে তোলার যুদ্ধ। ছোটো থেকেই তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয় বড়ো হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে তোমাদের। তার মেয়েরা আজ প্রতিষ্ঠিত।
এটা আমার আম্মুর গল্প...
জমিদারবাড়িতে বিয়ে হলেও স্বামীর সাথে এককাপড়ে সন্তানসহ বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। হাতে একটা পয়সাও নেই। শুধু আছে কয়েকবিঘা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি। নিজের গয়না বিক্রী করে সেই টাকায় কিছু জমি কিনে শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে সন্তানের ক্যান্সার ধরা পরে। তার চিকিৎসায় জমিজায়গা বিক্রী হয়ে যায়। তবুও হাল ছাড়েনা মেয়ে। গ্রামের স্কুলে ফোর অবধি প্রথম হয়েছে সে... বিয়ের কারণে আর পড়াশোনা না হলেও পাঁচ সন্তানকে শিক্ষা দেয় কষ্ট করেও। মুরগী পুষে, গরু , ছাগল পুষে সংসার চলে ঠিক।
এটা আমার নানীজানের গল্প।
ষাটের উত্তাল দশক। স্বামী অধিকাংশ সময়েই ফেরার। বিখ্যাত নকশাল আন্দোলনের জের। বাড়িতে প্রতিদিনই কেউ না কেউ লুকিয়ে থাকে। তারপর আছে আশ্রিত মানুষেরা। ছোটো ছোটো সন্তানদের নিয়ে সংসার। ডিম ,দুধ সব্জি বেচে সংসার চলে। চাষবাসের দায়ও তার ঘাড়ে.... একা হাতে সব সামালায় কন্যা।
এটা আমার দাদির গল্প।
জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়েছে জমিদারের কন্যার। অপূর্ব সুন্দরী কন্যা আবিষ্কার করে স্বামীর সাথে অন্য নারীর সম্পর্ক।
মেয়ে আর একদিনও শ্বশুরবাড়িতে থাকেনি।
ঐ সময়ে শ্বশুরবাড়ি স্বামী ছেড়ে চলে আসা একটা অন্যরকম লড়াই।
গল্পটা আমার মামাবাড়ি সম্পর্কিত এক নানীজানের।
প্রেম করেছে মেয়ে। বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে রাজী নয়। ছেলের সবদিক থেকেই উপযুক্ত। তাও বাড়িতে রাজী না। মেয়ে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করবে তাও আবার প্রেম করে ? ছিঃ লোকে কি বলবে? মোদ্দা কথা , এটা সেই যুগে অসম্ভব একটা ব্যাপার ছিলো। ভালোবাসাকে মর্যাদা দিতে সেই "অসভ্য" মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। অবাধ্য মেয়ের সাথে বাপের বাড়ি সম্পর্ক রাখেনি বহুদিন। সেই যুগে এটা করতে অনেকটা সাহস লাগতো। গল্পটা আমার আম্মুর ফুফুআম্মার গল্প।
নারীরা কখনো কর্মহীন হয়না। প্রতিটা নারীর জীবনে থাকে অনন্য লড়াইয়ের গল্প। কেউ জয়ী হয়, কেউ হয়না।
কিন্তু লড়াইটা থেকে যায়। গল্পে কিংবা ইতিহাসে।
কর্মজীবি নারীদের দিনে সব নারীদের সবরকম লড়াইকে কুর্ণিশ।

কুন্তলদা

সদ্য অর্কূট খুলেছি... এই ধরুন ২০০৭ সাল হবে। কলেজে তখন সদ্য ভর্তি হয়েছি। তখন বাড়িতে নেট ছিলো না, কম্পিউটারও না। সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ঘন্টাপ্রতি দশ টাকায় নেট করতে হতো। বড়োবাজারের কোহিনূর কাটার্সের পিছনের সাইবার ক্যাফেতে বসে প্রথম অ্যাকাউন্ট খুললাম। আমার বোনই খুলে দিয়েছিলো। সবাইকে বন্ধুত্ব অনুরোধ পাঠাচ্ছি। তখনই খুঁজে পাই কুন্তলদাকে, কুন্তল ব্যানার্জী। ভুল করে অন্য লোক ভেবে অ্যাড করেছিলাম। কলেজে আমার সাথে কুন্তল বলে একটা ছেলে পড়তো ... সায়ন্তীর সাথে মিউচুয়াল থাকায় ভেবেছিলাম এই সেই ছেলে। রিকু দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় অ্যাক্সেপ্ট করে। তারপরে বেশ কিছুদিন পরে জানতে পারি এ আমাদের ক্লাসের কুন্তল না। আমার থেকে সিনিয়র এবং বেশ অনেকটাই বড়ো।
২০০৯ নাগাদ বাড়িতে নেট কানেকশন আসে। ল্যাপটপও কিনে দেয় আব্বু। ততদিনে খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে কুন্তলদা। আর অানফ্রেন্ড করিনি।
আমরা একসঙ্গে ফার্মভিলা খেলতাম, সিটিভিলা খেলতাম... চ্যাট করতাম, গল্প করতাম নানা বিষয়ে। মূলত গল্পের বই নিয়েই। 
তারপর একদিন দেখাও করি। প্রথমবার যেবার দেখা করার কথা... আমি বেমালুম ভুলে গেছিলাম... ওদিকে কুন্তলদা হলদিরামের কাছে দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষায়... এদিকে আমি তখন ব্যান্ডেল পেরিয়ে বর্ধমানের দিকে। কুন্তলদা যখন আমাকে ফোন করে, তখন আর ফেরা সম্ভব না। কিছুই মনে করেনি কুন্তলদা... আমি কিন্তু খুবই লজ্জিত হয়েছিলাম। পরে অবশ্য দেখা হয়েছে বহুবার। রোগা, ফরসা, লম্বা , শান্ত ছেলেটা... 
কলকাতা যখন প্রথমবার আসি... কলকাতা আমার একদমই পছন্দ ছিলোনা। কুন্তলদার হাত ধরে প্রথম কলকাতা চেনা, কলকাতাকে ভালবাসতে শেখা। কলেজস্ট্রিট, কফিহাউস, প্যারামাউন্ট হয়ে কলেজস্কোয়ার... বৃষ্টির কলকাতায় কাঁচা আম খেতে খেতে এক ছাতার তলায় হাঁটতে হাঁটতে দুজনে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নিয়ে আলোচনা করতাম। আমাদের দুজনেরই প্রিয় লেখক ছিলেন শীর্ষেন্দু আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। 
তারপর ছিলো ফুচকা খাওয়া... মোদ্দা কথা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একজন ছিলো কুন্তলদা। বন্ধু, খেলার সাথী, কলকাতার সাথী। এইভাবেই দুটো বছর চলে যায়। আমার জীবনে আসে মাজহার। তার একেবারেই পছন্দ ছিলোনা কুন্তলদাকে। চ্যাট করলে কিংবা দেখা করলে সে ভীষণ রেগে যেতো... ঝগড়া করতো। কিন্তু তারপরেও আমি কুন্তলদার সংস্পর্শ ছাড়তে পারিনি। সেই কুন্তলদা চলে গেলো আইআইটি কানপুরে রসায়ন নিয়ে গবেষণা করতে । আদ্যান্ত ফুটবলপাগল, কবিতাপ্রেমিক ছেলেটা কলকাতা ছেড়ে চলে গেলো উত্তরপ্রদেশ। ততদিনে আমারোও পড়া শেষ... আমিও চলে গেলাম ব্যাঙ্গালোরে। কিন্তু দুজনের বন্ধুত্বে এতটুকু ভাঁটা পরেনি। প্রতিবছর জন্মদিনে আমার কাছে একটা আর্চিসের কার্ড আসতো... কোনোবার ভুল হয়নি। আমার মন খারাপ, ব্রেক আপ, জীবনের সব কঠিন সময়ে সে আমার পাশে থেকেছে। আমার ভাই বোনের সাথেও তার সুসম্পর্ক ছিলো। 
হঠাৎ করে ২০১৬ সালে জানতে পারি... কুন্তল ব্যানার্জী বলে আদতে কেউ নেই। একটা ফেক নামের প্রফাইলের পিছনে অন্য একটা মানুষ... আসল নাম অভি মুখার্জ্জী। আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি প্রথমে। কুন্তলদা নিজেই বলেছিলো তার আসল পরিচয় ... ক্ষমা চেয়েছিলো প্রায় দশবছর নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখার জন্য। আমি ক্ষমা করেছিলাম... কারণ আমার কাছে নামটা নয়, মানুষটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কুন্তল ব্যানার্জ্জী আমার জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলো। শুধু আমি তাকে বলেছিলাম পৃথিবীতে আর সবাই কি বলে ভাবে জানি না, আমি তোমাকে কুন্তলদা বলেই ডাকবো। 
অদ্ভুতভাবে, অভি মুখার্জ্জী ছেলেটা অালাদা... একদমই আলাদা। কুন্তল ব্যানার্জীর ধারে কাছেও আসেনা। অভি ব্যানার্জ্জী এখন সাম্প্রদায়িকতা সমর্থন করে, বিজেপি করে। 
ফেসবুকের মার্কামারা সাম্প্রদায়িকদের সাথে তার ওঠাবসা। গতকাল বিজেপির গোপন ফেসবুক গ্রুপের একটা screenshot এ কুন্তলদার কমেন্ট দেখে অবাক হলাম। 
এই কুন্তলদাকে আমি চিনতাম না, এ অভি মুখার্জ্জী। 
শীর্ষেন্দুপাগল মোহনবাগানী এই লোককে আমি চিনি না। শীর্ষেন্দুর কিশোর সাহিত্য প্রেমিক, শ্রীজাতর কবিতার বই উপহার দেওয়া , কলেজস্কোয়ারে বসে নবীগঞ্জের দৈত্য কিংবা আনন্দমেলা নিয়ে গল্প করা লোক আজ দাঙ্গা অস্ত্র নিয়ে আলোচনা করছে। মুসলমানদের কি করে জব্দ করা যায় তার প্ল্যান কষছে... 
হয়তো এ পোড়া দেশে কিছুই এসে যাবে না কারোর। কিন্তু কুন্তলদা বলতে অজ্ঞান ঊনিশ বছরের সেই মুসলমান মেয়েটির কাছে আর কুন্তলদার অস্তিত্ব নেই। শুধু আছে গলার কাছে জমে থাকা একদলা কষ্ট। কুন্তলদা এখন শুধুই বিজেপি সমর্থক ডক্টর অভি মুখার্জ্জী।