Thursday, 2 May 2019

ঝুলন

এসব হলো সেই কালের কথা, যখন রাখী পূর্ণিমা রকষাবন্ধন হয়নি, দোলপূর্ণিমা হ্যাপি হোলি হয়নি।
তখন রাখীপূর্ণিমা হওয়ার একমাস আগে থেকে পাড়ায় পাড়ায় ঝুলন সাজানো হতো.. চলতো রাখী শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেও। বাচ্চারা মাটি, পুতুল, শ্যাওলা, গাছপালা দিয়ে ঝুলন সাজাতো।
বিশেষ করে পাড়ায় বিহারী বাড়ি যেদিকে আছে সেদিকে বেশী করে ঝুলন দেখা যেতো। রাস্তার ধারের ঝোলা বারান্দা কিংবা ড্রেনের উপরের স্ল্যাবে বাচ্চারা হরেক কিসিমের ঝুলন সাজাতো। নয়ন স্যারের বাড়ির সামনে সব্জিবাজারের মুখটাতে, পুশিদিদিমণির বাড়ি সামনে, পার্কাস রোডে সারসার ঝুলনের পশরা সাজাতো বাচ্চারা... আর রাস্তা দিয়ে কেউ গেলেই পয়সা চাইতো। দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা.. কেউ কেউ আবার এক টাকাও দিতো।
তেঁতুলবাজারের মোড়ের মাথায় বর্ষামঙ্গল দোকানের ঠিক সামনে মুচীকাকুর পাশেই ঝুলনের পশরা নিয়ে দোকানদার বসতো সার সার। মাটির পুতুল, মাটির খেলনা হাঁড়ি কুরি সে অনেক কিছু। মাটির বাঘ, গরু,ছাগল থেকে আরম্ভ করে রামকৃষ্ণ, সারদামা অবধি পাওয়া যেতো।
আমি সারাবছর অপেক্ষা করে থাকতাম ঝুলনের সময়টার জন্য। এই সময়েই খেলনাপাতির সবথেকে সুন্দর মাটির হাঁড়ি, শেণি, থালা বাসন, কড়াই পাওয়া যেত।
শেণি সমেত হাঁড়ি নিলে এক টাকা দাম... সেই হাঁড়ির গায়ে লাল হলুদ রঙের নক্সা। দাদাভাই মাটির খেলনা কিনে দিত অনেক রকমের। আর দুইবোনের দুটো হাঁড়ি... আমি আবার ওতে সন্তষ্ট নই...আমার একখান কড়াইও চাই। আমি খেলনাবাটি খেলতে খুব ভালোবাসতাম।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাড়ির বাইরে খেলা করা আমাদের মানা ছিলো.. পাড়ার মধ্যে শুধু জুঁইদের বাড়ি যেতাম.. কখনো কখনো ফুচুদের বাড়ি.. খুব ছোটো বেলায় রামিজদের বাড়িও যেতাম। আধঘন্টার বেশী বাড়ির বাইরে থাকলে দাদাভাই চেঁচামেঁচি করতেন। অগত্যা সবাই আমাদের বাড়িতে এসেই খেলতো... কেউ না এলে আমরা তিনভাই বোনেই খেলতাম।
ঝুলন বানাতে বালি লাগে... আমাদের একতলার বাথরুমের পাশে তখন বালি ডাঁই করে রাখা থাকতো.. আমাদের ফুলটুসী মুরগীটা ঐ বালিতে খেলা করতো। ফুলটুসীর মতো সুন্দর মুরগী আমি আর এজন্মে দেখলাম না। হাল্কা কালচে গোলাপী পালকের উপর সোনালী রং এর ছটা। আমার এই প্রিয় মুরগী কলকে পাতা খেয়ে একদিন ধুম করে মরে গেলো। আমি এক সপ্তাহ কেঁদেছিলাম। ফুলটুসী নিয়ে বহু গল্প আছে... সেই গল্প আর একদিন হবে।
যাইহোক, বালি ছাদে নিয়ে এসে বালির বেস করে, তারপর সিনারী সাজানোর পর্ব চলতো। গ্রামবাংলা সাজানোই সবথেকে সহজ... অতএব কলার পাতা সমেত মাটির বাড়ি বসিয়ে সেই বাড়ির সামনে লম্বা লাল সুরকির রাস্তা। ইঁট ঘষে সুরকি বানানো হতো... হলুদ সুরকি, লাল সুরকি, খয়েরী সুরকি।
গাছপালা সাজানোর জন্য ফুলটা, ছোটো ছোটো গাছ আনতে যেতাম আঙুরদার পার্কে। ওখানে অনেক রকমের ফুলগাছ আছে। তারপর তা দিয়ে বাগান, প্লাস্টিকের বাটি বালি দিয়ে ঢেকে তাতে জল দিয়ে পুকুর। আমার তিনচার খানা কালো টুপী পরা হলুদ প্লাস্টিকের হাঁস ছিলো... টিকটিকির ডিম চকোলেট ভরা ছিলো হাঁসগুলোর পেটে.. ওদের ভাসানোর চেষ্টা চলতো পুকুরের.. পুকুরের অনুপাতে হাঁস বড়ো! পুকুরের চারপাশে শ্যাওলার প্রলেপ.. তখন আমাদের বাড়ির পাঁচিলে অনেক শ্যাওলা হতো.. আর লুচিপাতা গাছ, হলদে ফুল ওলা কুকুর শোঁকা গাছও অনেক হতো। কুকুর শোঁকা ফুল কেন বলা হতো জানিনা.. তবে সবাই বলতো।
যাগগে, ঝুলন তো সাজানো হলো। কিন্তু আমাদের ছাতে এসে আর কে ঝুলন দেখবে!! টাকা পয়সাও পাওয়া যাবে না! কি দুঃখ , কি দুঃখ। অগত্যা আম্মু, আব্বু, দাদি, দাদা সবাইকে টেনে এনে ঝুলন দেখাতাম... দাদা টাকা দিয়ে দিতেন। একটাকা, দুটাকা কিংবা পাঁচটাকা! দাদি আর আব্বু দিতো না! আমার আব্বুর কাছে তখন টাকা পাওয়া বিশাল ব্যাপার... তাও এমনি এমনি দিতো না। একটা পাকা চুলে দশপয়সা দিতো! তখন বেশী পাকা চুল নেই, আর টাকাও নেই! আমি মনে মনে বলতাম আব্বুর চুলগুলো সব পাকা করে দাও আল্লাহ! সে শখ আর পূর্ণ হতো না।
এখন আব্বুর অনেক চুল পেকে গেছে... এখন আর এক টাকায় একটা ইক্লেয়ার কিংবা পঞ্চাশ পয়সায় হাঁস মুরগীওলা টিকটিকির ডিমও পাওয়া যায়না।
এখনকার বাচ্চারা ঝুলনও সাজায় না আর!
তারা এখন ক্যান্ডিক্রাশ আর ফিফা খেলে!
আমাদের ছোটোবেলাগুলো বড়ো রঙিন ছিলো... জলরং এ আঁকা রঙিন স্বপ্নের মতো ..

No comments:

Post a Comment