এই সপ্তাহে পরিচিত কিংবা স্বল্পপরিচিত মেয়েদের সত্যিকারের গল্প লিখবো ঠিক করেছি। প্রথম গল্প খুবই ছোটো।
মেয়েটি সম্পর্কে আমার মাসি হয়। যদিও আমার থেকে অনেকটাই ছোটো। আমার আম্মুর এক দূর সম্পর্কের মামার মেয়ে। একদিন সম্ভবত কোনো এক রবিবার হবে, কারণ আমি সেদিন বর্ধমানে,বিকেলের দিকে নানাভাই এলেন মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে। এটা সেটা নানারকমের গল্প চলছে... পাত্রপক্ষ নাকি খুবই ভালো...বংশ ভালো, বড়োলোক, বর্ধমানের বড়োবাজারে দোতলা বাড়ি।একটাই ছেলে..ব্যবসা আছে.. কিছু একটা চাকরিও করে সম্ভবত ...ঠিক মনে পরছে না। আমি যা জিজ্ঞাসা করি সাধারণ তাই করে ফেললাম... “হবু বরের গল্প তো বহু শুনলাম...এবার একটু হবু বউয়ের গল্প শুনি!!!”
নানাভাই হেলে বললেন “এই তো মেয়ের ঊনিশ বছর বয়স.. সেকেন্ড ইয়ারে উঠলো।”
আমি খুবই অবাক হয়ে বললাম “এখনি বিয়ে দেওয়ার কি দরকার ছিলো? গ্রাজুয়েশনটা অন্তত করা উচিত ছিলো।এতো কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বয়স কম থাকলে মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত বেশী হয়... বিয়ে ভাঙার চান্সও বেশী থাকে।”
পাশ থেকে বিব্রত আম্মু বলে উঠলো.. “এইসব কথা বলে এই সময়?”
আমি বললাম “যা সত্যি, সেটাই বলছি। এখনো সময় আছে... পরে কিছু হলে আফসোসের সীমা থাকবে না।”
নানাভাই বললেন “মামণি, সবাই কি তোমার মতো পড়াশোনায় ভালো হয়? আমার মেয়ে বোকা সোকা, শান্ত মানুষ… সাত চড়ে রা কাটে না… তাছাড়া পড়াশোনায় ভালো না। এই বাজারে ঐ পড়াশোনায় চাকরি পাবে না।”
আমি তখন বেশ বিরক্ত... একটু রেগেই বললাম “পড়াশোনায় সবাই ভালো হবে এমনটা নয়... তা বলে আপনি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট না করেই বিয়ে দিয়ে দেবেন? কিছু ভাবুন না ভাবুন অন্তত পরবর্তী প্রজন্মের কথাটা ভাবুন।
আমিও পড়াশোনায় আহামরি নই, কিন্তু আমার আব্বু আম্মু হতাশ হয়ে চেষ্টা ছেড়ে দেয়নি... তাই আজকে আমি একটা চাকরি অন্তত করছি। যদি বাপ মাই আশা ছেড়ে দেয় তাহলে কি করে হবে?”
যাগগে...তারপরেও বিয়ের নেমন্তন্ন হলো... বিয়েও হয়ে গেলো!
তারপর ছয় সাত মাস পরের কথা। হঠাৎ শুনি মায়ের ঐ মামা এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গন্ডগোল শুরু হয়েছে…মেয়েকে নাকি মারধোর করা হয়, ঠিক মতো খেতে দেওয়া হয়না… সারাদিন ঘরের দরজায় তালা মেরে রাখে শাশুড়ি যাতে দিনের বেলা বউ ঘুমোতে না পারে। কাজের মেয়েও ছাড়িয়ে দিয়েছে… শুধু তাই নয় বরের নাকি অন্য কোনো মেয়ের সাথে প্রেম আছে। মেয়েটা সেসব জেনে ফেলাতে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেছে।
এতকিছু হওয়ার পরেও মেয়ে কিন্তু বাপের বাড়িতে কিছু বলেনি। ঐ যে ভারতীয় নারী…মরে যাবে তবু শ্বশুরবাড়ীর বদনাম মুখ ফুটেও করবে না!
কিন্তু বাদ সেধেছে শরীর… প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরেই বাপের বাড়ীর নজরে আসে বিষয়টা। তারপরেই সব জানাজানি…
নানাভাই আবার একদিন এসেছিলেন… আমি তখন বর্ধমানে।
আমাকে দেখেই বললেন “তুমি ঠিক বলেছিলে মা। তখন যদি তোমার কথায় কান দিতাম আজ এই দিন দেখতে হতো না। আমি খুব ভুল করেছি।”
এরপরে সম্ভবত মেয়েটা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে.. আর তারপরে নিজের গ্রামেরই এক গরীব ছেলের সাথে বিয়ে হয়। ছেলেটার পরিবার খুব অবস্থাপন্ন না হলেও ছেলেটা কিছু একটা করে…যাতে এখন অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে।
শুনছি মেয়েটা আপাতত খুবই সুখে আছে।
আসলে জীবনে বংশ, টাকা, স্টেট্যাস ইত্যাদিই সব নয়… সবথেকে দরকারি ভালো থাকা আর ভালো রাখা।
অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যে কতটা সমস্যার সেটা অভিভাবকদেরই বুঝতে হবে। ভালো ছেলের সন্ধান সবসময়ই পাওয়া যাবে… না পাওয়া গেলেও অসুবিধা নেই, কারণ বিয়েটাই জীবনের সবকিছু না। মেয়েদের শিক্ষিত করাটা, নিজের পায়ে দাঁড় করানোটা খুব জরুরী… তাহলেই সমাজের এই নারী নির্যাতনের মতো সমস্যাগুলো অনেকাংশেই কমবে বলে আমার ধারণা।
আর একটা কথা কোনো এক মহাপুরুষ বলে গেছেন.. একটা ছেলে শিক্ষিত হলে শুধু সেই শিক্ষিত হয়… কিন্তু একটা মেয়ে শিক্ষিত হলে পরের পুরো প্রজন্ম শিক্ষিত হয়। মেয়েদের শিক্ষিত হওয়াটা বহু জরুরী... অন্তত পৃথিবীর জন্য... মানুষের জন্য। বাকিসব না হয় বাদই দিলাম।
No comments:
Post a Comment