তখনো আজকের মতো যান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি পৃথিবীটা। আমার দোতলা বাড়ি থেকে আসিফ স্যারের বাড়ির নারকেল গাছগুলো তখন দেখা যেত ছাদে উঠলেই..... ক্লাবের সামনে কদম গাছটাও তখন পাতা নেড়ে নেড়ে নিজের খুশি জানাতো... এই তো জাস্ট কিছু বছর আগের কথা বলছি... সেই সময়ের গল্প যখন এক টাকায় তিনটে ফুচকা, দুটাকায় একটা বাপুজীর কেক, পঞ্চাশ পয়সায় রঙিন কাঠিওলা আইসক্রীম পাওয়া যেত.... স্কুলের গেটের সামনে আচার কাকু এক টাকায় এত্তোটা আলু কাবলি দিতো। তখন আমার কাছে একটা টাকা মানে অনেক টাকা.... এক টাকায় অনেক জলছবি পাওয়া যেত... পানি দিয়ে ঘষে আস্তে করে কাগজটা তুললেই রং বেরং এর গল্প ফুটে উঠতো পাতায়।
আমার আব্বু তখন বেশ গরীব, ছাপোষা মধ্যবিত্ত যে কিনা তিন ছেলে মেয়ের লেখাপড়া, আব্বা মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমসিম। চাষবাস করে কতো আর ইনকাম, তাই শহরে থাকা সব কিছুই কিনে খাওয়া।
আমরা বেশ ভালো স্কুলেই পড়তাম, বর্ধমানের সেরা সরকারি স্কুল.... সেরকম খরচা ছিলো না তারপরেও বইখাতা , তবলার স্যার, আঁকার সরঞ্জাম, গানের স্যার , জিমন্যাস্টিক সবের খরচা চালাতে চালাতে আমার আব্বুটা বেশ গরীব! একটা বিলাসিতা করারও টাকা নেই। একটু দূরে কারোর বাড়ি যেতে হলে হেঁটেই যেতে হবে.... পনেরো টাকা রিকশা ভাড়া অনেক! আমার সদ্য হাঁটতে শেখা ভাইটা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে আব্বু আম্মুর হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছে!!! এই তো সেদিনের কথা।
মোট কথা তখন আমরা বেশ গরীব।
আমার আম্মু একজন অসাধারণ মহিলা। অন্নপূর্ণা বলতে যা বোঝায় ঠিক তেমনি। কপালে লাল একটা টিপ, হাতে দুগাছা সোনা বাঁধানো পলা। আমার আম্মু গৃহবধু.... সারাদিন ঘরের কাজ , রান্নাবান্না, তারপর আমাদের পড়ানো! তখন আমাদের বাড়িতে কাজের লোক নেই, ছুটির দিনে আমি আর নিউ দুটো করে চারটে ঘর মুছতাম, বাকিটা আম্মু! কতই বা বয়স হবে তখন দশ কি বারো কিংবা আরো ছোটো।
বার্ষিক পরীক্ষার পরে একমাস ছুটি.... সেই সময়টাতেই নববর্ষ আসতো হৈ হৈ করে। আমাদের বর্ধমানে একমাস ধরে চৈত্র সেল চলে। সেকি হৈ হৈ ব্যাপার! রাস্তায় বেরোনো মুশকিল। আমার আম্মু চৈত্রসেলের শেষ দিনে দুই বোনের জন্য দুটো ফ্রীল দেওয়া ফ্রক কিংবা অ্যালান ফ্রক কিনে দিতো। হাল্কা মিষ্টি রঙের। সারা বছর ধরে একটাকা দুটাকা করে জমিয়ে বছর শেষে আমার গৃহবধু আম্মুটা ছেলে মেয়েদের জন্য জামা কিনতো, আব্বুকে অনেক সময় না জানিয়েই।
আহা, নববর্ষের দিন নতুন জামা গায়ে ঠেকাতে হয় যে। অনেক ঘুরে ঘুরে সস্তাতে সুন্দর জামা হতো যেখানে , সেখান থেকেই নতুন জামা কেনা হতো। আমরা নতুন জামার আনন্দে উৎফুল্ল। এদিকে জানতেও পারলাম না আমার আব্বু আম্মু কিন্তু পুরোনো জামা পরেই নববর্ষ করছে।
নববর্ষের দিন গ্রামে আমাদের পুকুরে জাল ফেলা হতো। ঐদিন মাছ বিক্রী করলে একটু বেশি টাকা পাওয়া যাবে এই আশায়! ভোরবেলা কমলাদাদা এসে ঝুড়িতে করে মাছ ফেলতো সদর দরজার কাছে ছোটো কলের মুখে। আম্মু মাছ বাছছে ইঁটে ঘষে ঘষে, আমিও বড়ো হওয়া প্রমাণের চেষ্টায় হেল্প করার চেষ্টা করতাম মাঝেমধ্যে। সকালে আম্মু ঘুম থেকে তুলে দিয়েই হারমোনিয়ামটা বের করে দিতো। নববর্ষের দিনে গানের রেওয়াজ মাস্ট আর তারপর বাংলা পাঠ্যবইয়ের কবিতা পাঠ। ঐদিন নাকি গান না গাইলে বা বই না খুললে সারা বছর আর পড়াশুনা হবেনা! দেবী সরস্বতী পালিয়ে যাবে!!! যদিও বছরে দুবার নববর্ষেই আম্মু একই কথা বলতো!
আমরা দুবোনে শুরু করতাম এসো হে বৈশাখ গান দিয়ে, প্রতিবছর। তারপর গানের রেওয়াজ শেষ হলে স্নান করে নতুন জামা। সেদিন বাড়িতে ভালো কিছু খাবার বানানো হবেই, পোলাও,মাছের কালিয়া , মিষ্টি, হোয়াইট হাউসের দৈ এরকম অনেক কিছু।
বিকেলে আরো মজা... হাল খাতার নেমন্তন্ন দোকানে দোকানে। আব্বু আম্মুর সাথে বেরিয়ে পড়তাম নেমন্তন্ন রক্ষা করতে... কোনো কোনো দোকান আবার কোল্ড ড্রিংকস খাওয়াতো... বাকিরা সরবৎ, কেউবা ডাবের পানি। তখন কোল্ড ড্রিংকস মানে বিশাল একটা ব্যাপার। মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডারে ভরে যেতো খাওয়ার টেবিলটা।
আমরা প্যাকেট খুলে খুলে ভালো ভালো মিষ্টিগুলো হাপিশ করে দিতাম লুকিয়ে লুকিয়ে।
এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছি... জীবনযাত্রার মান বদলে গেছে।
এখন আম্মু আব্বু নয়, আমিই নববর্ষে নতুন জামা কিনে দিই ওঁদের। কমলাদাদাও এবছর মারা গেছেন। আমাদের পুকুরে জাল ফেলার জন্য অন্য গ্রাম থেকে লোক আনতে হয়.... এখন আমাদের একটা ছোট্ট মাছের আড়ৎ হয়েছে যেখানে হালখাতা হয়... সে আর এক নতুন গল্প।
আর আমাদের শৈশবের হাল খাতার মতো উৎসাহ আর নেই। পরিবর্তনের হাওয়ায় ফুটপাতের সেলের জামার বদলে স্থান পেয়েছে প্যান্টালুনস, ব্র্যান্ড ফ্যাক্টরি। যুগের হাওয়ায় ভেসে গেছি আমরাও... তবু আমার মফস্বল শহরটাতে প্রতিবার বৈশাখ আসে... লাল দড়িতে বাঁধা নতুন খাতা, আমপাতার গন্ধে মিলেমিশে যায় আমার শহরের প্রতিটা অলিগলি। এখনো আমরা নতুন জামা পরি , হালখাতার নেমন্তন্ন খেতে যাই... শুধু আমার আম্মুর এক এক করে কষ্টের জমানো টাকায় নতুন জামার ঘ্রাণ আর পাইনা। আমরা বড়ো হয়ে গেছি... আসলেই অনেকটা বড়ো।
আমার আব্বু তখন বেশ গরীব, ছাপোষা মধ্যবিত্ত যে কিনা তিন ছেলে মেয়ের লেখাপড়া, আব্বা মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমসিম। চাষবাস করে কতো আর ইনকাম, তাই শহরে থাকা সব কিছুই কিনে খাওয়া।
আমরা বেশ ভালো স্কুলেই পড়তাম, বর্ধমানের সেরা সরকারি স্কুল.... সেরকম খরচা ছিলো না তারপরেও বইখাতা , তবলার স্যার, আঁকার সরঞ্জাম, গানের স্যার , জিমন্যাস্টিক সবের খরচা চালাতে চালাতে আমার আব্বুটা বেশ গরীব! একটা বিলাসিতা করারও টাকা নেই। একটু দূরে কারোর বাড়ি যেতে হলে হেঁটেই যেতে হবে.... পনেরো টাকা রিকশা ভাড়া অনেক! আমার সদ্য হাঁটতে শেখা ভাইটা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে আব্বু আম্মুর হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছে!!! এই তো সেদিনের কথা।
মোট কথা তখন আমরা বেশ গরীব।
আমার আম্মু একজন অসাধারণ মহিলা। অন্নপূর্ণা বলতে যা বোঝায় ঠিক তেমনি। কপালে লাল একটা টিপ, হাতে দুগাছা সোনা বাঁধানো পলা। আমার আম্মু গৃহবধু.... সারাদিন ঘরের কাজ , রান্নাবান্না, তারপর আমাদের পড়ানো! তখন আমাদের বাড়িতে কাজের লোক নেই, ছুটির দিনে আমি আর নিউ দুটো করে চারটে ঘর মুছতাম, বাকিটা আম্মু! কতই বা বয়স হবে তখন দশ কি বারো কিংবা আরো ছোটো।
বার্ষিক পরীক্ষার পরে একমাস ছুটি.... সেই সময়টাতেই নববর্ষ আসতো হৈ হৈ করে। আমাদের বর্ধমানে একমাস ধরে চৈত্র সেল চলে। সেকি হৈ হৈ ব্যাপার! রাস্তায় বেরোনো মুশকিল। আমার আম্মু চৈত্রসেলের শেষ দিনে দুই বোনের জন্য দুটো ফ্রীল দেওয়া ফ্রক কিংবা অ্যালান ফ্রক কিনে দিতো। হাল্কা মিষ্টি রঙের। সারা বছর ধরে একটাকা দুটাকা করে জমিয়ে বছর শেষে আমার গৃহবধু আম্মুটা ছেলে মেয়েদের জন্য জামা কিনতো, আব্বুকে অনেক সময় না জানিয়েই।
আহা, নববর্ষের দিন নতুন জামা গায়ে ঠেকাতে হয় যে। অনেক ঘুরে ঘুরে সস্তাতে সুন্দর জামা হতো যেখানে , সেখান থেকেই নতুন জামা কেনা হতো। আমরা নতুন জামার আনন্দে উৎফুল্ল। এদিকে জানতেও পারলাম না আমার আব্বু আম্মু কিন্তু পুরোনো জামা পরেই নববর্ষ করছে।
নববর্ষের দিন গ্রামে আমাদের পুকুরে জাল ফেলা হতো। ঐদিন মাছ বিক্রী করলে একটু বেশি টাকা পাওয়া যাবে এই আশায়! ভোরবেলা কমলাদাদা এসে ঝুড়িতে করে মাছ ফেলতো সদর দরজার কাছে ছোটো কলের মুখে। আম্মু মাছ বাছছে ইঁটে ঘষে ঘষে, আমিও বড়ো হওয়া প্রমাণের চেষ্টায় হেল্প করার চেষ্টা করতাম মাঝেমধ্যে। সকালে আম্মু ঘুম থেকে তুলে দিয়েই হারমোনিয়ামটা বের করে দিতো। নববর্ষের দিনে গানের রেওয়াজ মাস্ট আর তারপর বাংলা পাঠ্যবইয়ের কবিতা পাঠ। ঐদিন নাকি গান না গাইলে বা বই না খুললে সারা বছর আর পড়াশুনা হবেনা! দেবী সরস্বতী পালিয়ে যাবে!!! যদিও বছরে দুবার নববর্ষেই আম্মু একই কথা বলতো!
আমরা দুবোনে শুরু করতাম এসো হে বৈশাখ গান দিয়ে, প্রতিবছর। তারপর গানের রেওয়াজ শেষ হলে স্নান করে নতুন জামা। সেদিন বাড়িতে ভালো কিছু খাবার বানানো হবেই, পোলাও,মাছের কালিয়া , মিষ্টি, হোয়াইট হাউসের দৈ এরকম অনেক কিছু।
বিকেলে আরো মজা... হাল খাতার নেমন্তন্ন দোকানে দোকানে। আব্বু আম্মুর সাথে বেরিয়ে পড়তাম নেমন্তন্ন রক্ষা করতে... কোনো কোনো দোকান আবার কোল্ড ড্রিংকস খাওয়াতো... বাকিরা সরবৎ, কেউবা ডাবের পানি। তখন কোল্ড ড্রিংকস মানে বিশাল একটা ব্যাপার। মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডারে ভরে যেতো খাওয়ার টেবিলটা।
আমরা প্যাকেট খুলে খুলে ভালো ভালো মিষ্টিগুলো হাপিশ করে দিতাম লুকিয়ে লুকিয়ে।
এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছি... জীবনযাত্রার মান বদলে গেছে।
এখন আম্মু আব্বু নয়, আমিই নববর্ষে নতুন জামা কিনে দিই ওঁদের। কমলাদাদাও এবছর মারা গেছেন। আমাদের পুকুরে জাল ফেলার জন্য অন্য গ্রাম থেকে লোক আনতে হয়.... এখন আমাদের একটা ছোট্ট মাছের আড়ৎ হয়েছে যেখানে হালখাতা হয়... সে আর এক নতুন গল্প।
আর আমাদের শৈশবের হাল খাতার মতো উৎসাহ আর নেই। পরিবর্তনের হাওয়ায় ফুটপাতের সেলের জামার বদলে স্থান পেয়েছে প্যান্টালুনস, ব্র্যান্ড ফ্যাক্টরি। যুগের হাওয়ায় ভেসে গেছি আমরাও... তবু আমার মফস্বল শহরটাতে প্রতিবার বৈশাখ আসে... লাল দড়িতে বাঁধা নতুন খাতা, আমপাতার গন্ধে মিলেমিশে যায় আমার শহরের প্রতিটা অলিগলি। এখনো আমরা নতুন জামা পরি , হালখাতার নেমন্তন্ন খেতে যাই... শুধু আমার আম্মুর এক এক করে কষ্টের জমানো টাকায় নতুন জামার ঘ্রাণ আর পাইনা। আমরা বড়ো হয়ে গেছি... আসলেই অনেকটা বড়ো।
অনেকগুলো নববর্ষ পেরিয়ে আরো একটা নতুন বছর এসেছে।
শুভ নববর্ষ সবাইকে... ভীষণ ভালো কাটুক আগামী বছরটা।
শুভ নববর্ষ সবাইকে... ভীষণ ভালো কাটুক আগামী বছরটা।
দুবছর আগে লিখেছিলাম।
No comments:
Post a Comment