Thursday, 2 May 2019

কুন্তলদা

সদ্য অর্কূট খুলেছি... এই ধরুন ২০০৭ সাল হবে। কলেজে তখন সদ্য ভর্তি হয়েছি। তখন বাড়িতে নেট ছিলো না, কম্পিউটারও না। সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ঘন্টাপ্রতি দশ টাকায় নেট করতে হতো। বড়োবাজারের কোহিনূর কাটার্সের পিছনের সাইবার ক্যাফেতে বসে প্রথম অ্যাকাউন্ট খুললাম। আমার বোনই খুলে দিয়েছিলো। সবাইকে বন্ধুত্ব অনুরোধ পাঠাচ্ছি। তখনই খুঁজে পাই কুন্তলদাকে, কুন্তল ব্যানার্জী। ভুল করে অন্য লোক ভেবে অ্যাড করেছিলাম। কলেজে আমার সাথে কুন্তল বলে একটা ছেলে পড়তো ... সায়ন্তীর সাথে মিউচুয়াল থাকায় ভেবেছিলাম এই সেই ছেলে। রিকু দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় অ্যাক্সেপ্ট করে। তারপরে বেশ কিছুদিন পরে জানতে পারি এ আমাদের ক্লাসের কুন্তল না। আমার থেকে সিনিয়র এবং বেশ অনেকটাই বড়ো।
২০০৯ নাগাদ বাড়িতে নেট কানেকশন আসে। ল্যাপটপও কিনে দেয় আব্বু। ততদিনে খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে কুন্তলদা। আর অানফ্রেন্ড করিনি।
আমরা একসঙ্গে ফার্মভিলা খেলতাম, সিটিভিলা খেলতাম... চ্যাট করতাম, গল্প করতাম নানা বিষয়ে। মূলত গল্পের বই নিয়েই। 
তারপর একদিন দেখাও করি। প্রথমবার যেবার দেখা করার কথা... আমি বেমালুম ভুলে গেছিলাম... ওদিকে কুন্তলদা হলদিরামের কাছে দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষায়... এদিকে আমি তখন ব্যান্ডেল পেরিয়ে বর্ধমানের দিকে। কুন্তলদা যখন আমাকে ফোন করে, তখন আর ফেরা সম্ভব না। কিছুই মনে করেনি কুন্তলদা... আমি কিন্তু খুবই লজ্জিত হয়েছিলাম। পরে অবশ্য দেখা হয়েছে বহুবার। রোগা, ফরসা, লম্বা , শান্ত ছেলেটা... 
কলকাতা যখন প্রথমবার আসি... কলকাতা আমার একদমই পছন্দ ছিলোনা। কুন্তলদার হাত ধরে প্রথম কলকাতা চেনা, কলকাতাকে ভালবাসতে শেখা। কলেজস্ট্রিট, কফিহাউস, প্যারামাউন্ট হয়ে কলেজস্কোয়ার... বৃষ্টির কলকাতায় কাঁচা আম খেতে খেতে এক ছাতার তলায় হাঁটতে হাঁটতে দুজনে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নিয়ে আলোচনা করতাম। আমাদের দুজনেরই প্রিয় লেখক ছিলেন শীর্ষেন্দু আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। 
তারপর ছিলো ফুচকা খাওয়া... মোদ্দা কথা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একজন ছিলো কুন্তলদা। বন্ধু, খেলার সাথী, কলকাতার সাথী। এইভাবেই দুটো বছর চলে যায়। আমার জীবনে আসে মাজহার। তার একেবারেই পছন্দ ছিলোনা কুন্তলদাকে। চ্যাট করলে কিংবা দেখা করলে সে ভীষণ রেগে যেতো... ঝগড়া করতো। কিন্তু তারপরেও আমি কুন্তলদার সংস্পর্শ ছাড়তে পারিনি। সেই কুন্তলদা চলে গেলো আইআইটি কানপুরে রসায়ন নিয়ে গবেষণা করতে । আদ্যান্ত ফুটবলপাগল, কবিতাপ্রেমিক ছেলেটা কলকাতা ছেড়ে চলে গেলো উত্তরপ্রদেশ। ততদিনে আমারোও পড়া শেষ... আমিও চলে গেলাম ব্যাঙ্গালোরে। কিন্তু দুজনের বন্ধুত্বে এতটুকু ভাঁটা পরেনি। প্রতিবছর জন্মদিনে আমার কাছে একটা আর্চিসের কার্ড আসতো... কোনোবার ভুল হয়নি। আমার মন খারাপ, ব্রেক আপ, জীবনের সব কঠিন সময়ে সে আমার পাশে থেকেছে। আমার ভাই বোনের সাথেও তার সুসম্পর্ক ছিলো। 
হঠাৎ করে ২০১৬ সালে জানতে পারি... কুন্তল ব্যানার্জী বলে আদতে কেউ নেই। একটা ফেক নামের প্রফাইলের পিছনে অন্য একটা মানুষ... আসল নাম অভি মুখার্জ্জী। আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি প্রথমে। কুন্তলদা নিজেই বলেছিলো তার আসল পরিচয় ... ক্ষমা চেয়েছিলো প্রায় দশবছর নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখার জন্য। আমি ক্ষমা করেছিলাম... কারণ আমার কাছে নামটা নয়, মানুষটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কুন্তল ব্যানার্জ্জী আমার জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলো। শুধু আমি তাকে বলেছিলাম পৃথিবীতে আর সবাই কি বলে ভাবে জানি না, আমি তোমাকে কুন্তলদা বলেই ডাকবো। 
অদ্ভুতভাবে, অভি মুখার্জ্জী ছেলেটা অালাদা... একদমই আলাদা। কুন্তল ব্যানার্জীর ধারে কাছেও আসেনা। অভি ব্যানার্জ্জী এখন সাম্প্রদায়িকতা সমর্থন করে, বিজেপি করে। 
ফেসবুকের মার্কামারা সাম্প্রদায়িকদের সাথে তার ওঠাবসা। গতকাল বিজেপির গোপন ফেসবুক গ্রুপের একটা screenshot এ কুন্তলদার কমেন্ট দেখে অবাক হলাম। 
এই কুন্তলদাকে আমি চিনতাম না, এ অভি মুখার্জ্জী। 
শীর্ষেন্দুপাগল মোহনবাগানী এই লোককে আমি চিনি না। শীর্ষেন্দুর কিশোর সাহিত্য প্রেমিক, শ্রীজাতর কবিতার বই উপহার দেওয়া , কলেজস্কোয়ারে বসে নবীগঞ্জের দৈত্য কিংবা আনন্দমেলা নিয়ে গল্প করা লোক আজ দাঙ্গা অস্ত্র নিয়ে আলোচনা করছে। মুসলমানদের কি করে জব্দ করা যায় তার প্ল্যান কষছে... 
হয়তো এ পোড়া দেশে কিছুই এসে যাবে না কারোর। কিন্তু কুন্তলদা বলতে অজ্ঞান ঊনিশ বছরের সেই মুসলমান মেয়েটির কাছে আর কুন্তলদার অস্তিত্ব নেই। শুধু আছে গলার কাছে জমে থাকা একদলা কষ্ট। কুন্তলদা এখন শুধুই বিজেপি সমর্থক ডক্টর অভি মুখার্জ্জী।

5 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো... তুমি (তোমাকে তুমি ই বলছি তুমি আমার মেয়ের চেয়ে ও ছোট)এই ব্লগে আর লিখছ না? দারুণ হচ্ছিল লেখাগুলো... একটা বই প্রকাশ করো না

    ReplyDelete